মেহেরপুরের ইতিহাস যে সকল অঞ্চল নিয়ে বর্তমান মেহেরপুর জেলা গঠিত তা একটি
প্রাচীন জনপদ। ইতিহাসের সকল স্তরে এই জনপদটি অস্তিত্বশীল ছিল । এ অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, এর ভৌগলিক অবস্থা এবং অবস্থান বিবেচনা করলে মেহেরপুর
যে একটি প্রাচীন জনপদ তা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলের সকল লোকালয়ই গড়ে
উঠেছিল কোন না কোন নদীর তীরে । আর এই নদীগুলির অস্তিত্ব এ
অঞ্চলের প্রাচীনতম মানচিত্র তথা টলেমির মানচিত্রে বিদ্যমান।
টলেমির বর্ণনানুসারে অঙ্কিত মানচিত্রে মেহেরপুরের
অবস্থান Location of Meherpur in a
map drawn after Ptolemy’s description নদী তীরে গড়ে ওঠা এসকল জনপদ হরপ্পা মোহেনজোদারো
সভ্যতার সমসাময়িক। এই মন্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে এই জেলার লোকালয়ে
প্রাপ্ত পোড়ামাটির তৈরী বিভিন্ন ধরণের সাংসারিক উপকরণ এবং পুতুল তথা মূর্তি । এই মূর্তিগুলোর কোন কোনটি আশ্চর্যজনকভাবে হরপ্পায় প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর সাথে
সাদৃশ্যপূর্ণ, বিশেষ করে হাতি ঘোড়া এবং নারী মূর্তিসমুহ গঠণে এবং ভঙ্গিমায় হরপ্পায় প্রাপ্ত
নারী মূর্তির অবিকল প্রতিরূপ হিসাবে গণ্য করা যায়। মেহেরপুরের অন্যতম প্রাচীন বসতি গাংনীর নামটি এ
অঞ্চলের প্রাচীনতার ইঙ্গিতবাহী। পেরিপ্লাস ও টলেমির বর্ণনা থেকে জানা যায় আজকের বাংলাদেশ যে ভূভাগ নিয়ে গঠিত তা এক
সময়ে (১৫০ খৃষ্টাব্দে) গঙ্গাঋদ্ধি (গ্রীক উচ্চারণে গঙ্গারিড্ডি) নামক একটি
সুসংগঠিত ও সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল, তার রাজধানী (অথবা, অন্ততঃ একটি প্রধান নগর) ছিল Gange. তা থেকে (অর্থাৎ গাঙ্গে>গাঙ্গী>গাংনী)
গাংনীর নামকরণের সূত্র খোঁজাকে ভিত্তিহীন গণ্য করা যাবে না । নামকরণের এই প্রবণতা থেকে নামটির প্রাচীনত্ব সেই সূত্রে স্থানটির প্রাচীনত্ব
সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। (When
Greek historian Periplus talks about India in the first century AD,
apparently he speaks of Bangla. He says, "There is a river near it
called the Ganges (Ganga)" ... "On its bank is a market town which
has the same name as the river, Ganges (Gange, Gamga). (Quote from Sudheer's
India's Contribution to the World's Culture located on the Web).গাংনীর নাম করণে গাং বা নদীর সাথে সংযুক্ত থাকাটাই বেশী যুক্তিযুক্ত হলেও নামকরণের
রীতিটি যে অনেক প্রাচীন তা মেহেরপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর অবসথান ও
গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এ জেলার প্রধান নদী ভৈরব অতি প্রাচীন
কালের একটি নদী। প্রাগৈতিহাসিক কালে তো বটেই সামপ্রতিক ঐতিহাসিক
কালপর্বেও এই নদীটির স্বাভাবিক নাব্যতা বজায়
ছিল । নবাব আলীবর্দীখান বাগোয়ান ভ্রমণে এই নদী পথ ব্যবহার
করেছিলেন। ভারতের করিমপুর থানার উজানে জলাঙ্গী নদীর সাথে ভৈরবের
সংযোগ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এই নদীর তীরবর্তী জনপদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব
সম্পর্কে ধারণা দেয়। মেহেরপুর, গাংনী ও মুজিবনগরের প্রাচীন গ্রামগুলির সবগুলিই কোন না
কোন নদী কিংবা নদীর সাথে সংযুক্ত বৃহদায়তন জলাশয় যা বিল বা দহ হিসেবে পরিচিত তার
তীরে গড়ে উঠেছে। এসকল গ্রামগুলির মনুষ্যবসতিস্থল বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক গ্রামের মাটি খনন করলে
পোড়ামাটির নানা সাংসারিক উপকরণ মনুষ্য-মূর্তির যে অবশেষাদি পাওয়া যায় সেগুলি
নিয়ে কোন গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত পাওয়া না গেলেও ঐসকল মূর্তি ও গার্হস্থ্য
উপকরণাদির গঠণ থেকে এবং বিশেষতঃ
হরপ্পা-মোহেঞ্জারোতে প্রাপ্ত মনুষ্য-মূর্তির সাথে তাদের সাদৃশ্য থেকে এ ধারণা
করা যায় যে সেগুলি এবং সেই সূত্রে তাদের উৎসস্থলগুলি অনেক প্রাচীন। বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস বিস্মৃতির অতল গহ্বরে
হারিয়ে গেছে। খৃষ্টপূর্বকালেও বাংলার অস্তিত্ব ছিল ভিন্ন নামে ভিন্ন
অবয়বে। প্রাচীনযুগের ইতিহাসের কোন প্রামাণ্য সূত্র ঐতিহাসিকদের হাতে না থাকায় তারা ইতিহাসবহির্ভূত
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন ইতিহাসের কাঠামো নির্মানের চেষ্টা চালিয়েছেন। এদেশে আগত বিদেশি পর্যটক, পরিব্রাজক, অভিযাত্রীগণের বর্ণনা, লোককাহিনী, মহাকাব্য ও অন্যান্য ধর্মীয় শাস্ত্রাদি এবং পুরাণ ইত্যাদির
সহায়তায় প্রাচীন বাংলার একটি অনুমান নির্ভর ঐতিহাসিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা
করা হয়। যে সকল অঞ্চল নিয়ে আজকের বাংলাদেশ গঠিত, সেগুলি ইতিহাসের বিভিন্ন
পর্যায়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের সাথে যে সকল ঐতিহাসিক সত্তা জড়িত সে গুলো
হলো, গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গারিড্ডি, বঙ্গ, সমতট, বরেন্দ্র, পুন্ড্রবর্ধন, রাঢ়, গৌড়, তাম্রলিপ্তি, কর্ণসুবর্ণ, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ ইত্যাদি। এই সকল Historical entityগুলোর কোনটিরই ইতিহাসের কোন পর্বেই Exclusive existence বা নিরঙ্কুশ সত্তা ছিল না। একটি ঐতিহাসিক অস্তিত্ব আরেকটি ঐতিহাসিক অস্তিত্বের সূত্র বা পরিণতি হওয়ার
মতো সরল গতিতে এ অঞ্চলের ইতিহাস পরিচালিত হয়নি। ফলে প্রাচীন বাংলার ঘটনা প্রবাহকে ইতিহাসের শৃংখলে আবদ্ধ করা এক কঠিণ কাজ
হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাচীন বাংলার সামগ্রীক ইতিহাসের এ রকম অবস্থার
প্রেক্ষিতে মেহেরপুরের মতো একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল বিশেষের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধান
সহজসাধ্য বিষয় নয়। মেহেরপুরের ইতিহাস বিষয়ে উলেখযোগ্য কোন গবেষণাকর্ম
পরিচালিত না হওয়ায় এর ইতিহাস অনুসন্ধানের কোন সূত্রও পাওয়া যায় না। মেহেরপুরের ইতিহাস রচনা ও গবেষণার জন্য একটি বড় মাপের
আয়োজন দরকার । স্বল্প
পরিসরের ওয়েবপেজটিতে তা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাই সংক্ষেপে মেহেরপুরের ইতিহাস তুলে
ধরার চেষ্টা করা হলো। এই নিবন্ধ রচনায় সৈয়দ আমিনুল ইসলাম রচিত মেহেরপুরের ইতিহাস
ও বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত Bangladesh District Gazetteers Kushtia-থেকে ব্যাপকভাবে সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকা প্রাচীন ভারত তথা প্রাচীন বাংলার
ইতিহাস থেকেও সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এই নিবন্ধে মেহেরপুরের সঠিক ও
সামগ্রীক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এমন দাবী করা হচ্ছে না। নিবন্ধটি পাঠ করে মেহেরপুরবাসীদের মধ্যে ইতিহাস চেতনা ও মেহেরপুরের ইতিহাসের
প্রতি আগ্রহ জন্ম নিলেই রচনাটি সার্থক হয়েছে মনে করা হবে। প্রাচীন যুগঃ নিবন্ধের প্রারম্ভেই বলা হয়েছে বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের প্রত্যক্ষ কোন
সূত্র পাওয়া সহজসাধ্য নয়। যে কারণে প্রাচীন যুগের
ইতিহাস রচনার কাজটি যতটা না ইতিহাস সংশিষ্ট তার চাইতে বোধ করি বেদ-পুরাণ ও
লোককাহিনী-কাব্যাদি সংশিষ্ট। খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে প্রণীত
টলেমির মানচিত্রে গঙ্গার দক্ষিণাংশে অসংখ্য নদ-নদী ও জলাভূমির মধ্যে অসংখ্য
দ্বীপের অস্তিত্ব দেখা যায়। টলেমির মানচিত্রের ঐ অংশটিতেই
বর্তমান মেহেরপুর জেলার অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐ সময়ে এ অঞ্চলের জীবন যাত্রা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না, তবে ধারণা করা হয় এ অঞ্চলের
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনপদসমুহের অধিবাসীদের স্বাভাবিক
পেশা ছিল মৎস শিকার এবং কৃষি কাজ। মহাভারত, রঘুবংশ ও অন্যান্য পুরাণাদিতে যে বিবরণ পাওয়া যায় তা
থেকে ধারণা করা হয় যে মেহেরপুর রঘুবংশের সমসাময়িক কালে অর্থাৎ খৃষ্টীয় পঞ্চম শতকে বঙ্গ রাজ্যের (পূর্ব বঙ্গের) অধীনে ছিল। সপ্তম শতকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমন কালে মেহেরপুর জেলা সমতট বা
বঙ্গের অধীনে ছিল। ঐ সময়কাল থেকে ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম শাসনের আগমন পর্যন্ত মেহেরপুর বঙ্গ বা
গৌড়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। বাংলার ঐতিহাসিক কাল শুরু গুপ্ত যুগ থেকে। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো মেহেরপুরও গুপ্ত যুগে (৩২০-৫২০ খৃঃ) গুপ্ত
সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর
রাজা শশাঙ্ক (আনুমানিক-৬০৬ খৃঃ) গৌড় অধিপতি স্বাধীন
নৃপতি হিসাবে বাংলা শাসন করেন। তার মৃত্যুর পর ভয়াবহ রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। ৭৫০ খৃষ্টাব্দে গোপালকে গৌড়ের শাসনকর্তা নির্বাচিত করা হয় এবং এভাবে বাংলায়
পালরাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। পালদের কাছ থেকে গৌড় তথা বাংলার কর্তৃত্ব
দক্ষিণাত্য (কর্ণাটক) থেকে আগত সেন বংশ অধিকার করে নেয়। পাল বংশের সর্বশেষ নৃপতি মদনপাল (১১৪০-১১৫৫) কে যুদ্ধে পরাজিত করে
সামন্তসেনের পুত্র বিজয়সেন (১০৯৫-১১৫৮ খৃ.) গৌড় অধিকার করেন। গৌড়ের সাথে সাথে মেহেরপুর অঞ্চলও সেন বংশের অধীনে আসে। ১১৫৮ খৃ. বিজয়সেনের পুত্র বল্লাল সেন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ১১৭৯ খৃ. বল্লাল সেন তার পুত্র লক্ষণসেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে সিংহাসন ত্যাগ করেন। সেন বংশের শেষ নৃপতি লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে
মেহেরপুরের আমদহ এবং বাগোয়ান সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। মেহেরপুরের ভবানন্দপুর গ্রামে সেন আমলের দু’টি মুদ্রা পাওয়া গেছে বলে সৈয়দ
আমিনুল ইসলাম তাঁর মেহেরপুরের ইতিহাস গ্রন্থে উলেখ করেছেন। মুসলিম শাসনামলে মেহেরপুরঃ ১২০২খৃ. তুর্কি সেনানায়ক ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ
বখতিয়ার এক ঝটিকা আক্রমনের মাধ্যমে বিনা রক্তপাতে লক্ষণসেনের রাজধানি নদীয়া দখল
করে নিলে লক্ষণ সেন গোপন পথে নদীয়া ত্যাগ করে বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। মুসলিম শাসনামলে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের দ্রুত পালা বদল ঘটতে থাকে। ১২০২ খৃ. থেকে ১৫৭৪ খৃ. পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস ক্ষমতা দখল ও পাল্টা দখলের
মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়। অবশেষে ১৫৭৪ খৃ. মোগল সেনাপতি
মুনিম খান বাংলার সিংহাসনে আসীন দাউদ কররানিকে পদচ্যুত করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলায়
মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের
সন্নিকটবর্তী হওয়া সত্তেও রাজনৈতিক পালাবদলের এই চক্রাবর্তে মেহেরপুর কখনই
পাদপ্রদীপের আলোতে আলোকিত হয়নি। ইতিহাসের আকরগ্রন্থগুলির
মধ্যে মির্জা নাথানের বাহারস্তান-ই-গায়বিতে সেই সময়কার ঐতিহাসিক ঘটনাবলী প্রসঙ্গে
মেহেরপুরের সন্নিকটবর্তী বাগোয়ানের উলেখ পাওয়া যায়। ডক্টর ইরফান হাবিবের An Atlas of Mughal
Empire গ্রন্থেও বাগোয়ানের উল্লেখ আছে। ১৫৭৪ খৃ.-এর পরবর্তী সময়ে বর্তমান মেহেরপুর জেলা নিয়ে
গঠিত সমগ্র অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি মাসুম মোগল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ করেন । তার এই বিদ্রোহের সাথে ফতেহাবাদের মজলিশ কুতুব এবং
মসনদ-এ-আলা ঈসা খানও যোগ দেন। ১৬০৮ খৃ.-এ ইসলাম খান বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন এবং
ইহতিমাম খান ( @ মালিক আলী, মির্জা নাথান @ আলাউদ্দিন ইসফাহানি @ সিতাব খাঁর পিতা) কে মোগল নৌবহরের প্রধান (আমির-উল-বহর
)করে পাঠান হয়। ঐ সময়ে সন্নিহিত অন্যান্য অঞ্চলসহ মেহেরপুর জেলা
বিদ্রোহী মাসুম খান কাবুলির পুত্র সেনাপতি মির্জা মুমিনের জায়গীরভুক্ত ছিল। মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁর নির্দেশে নৌ-বাহিনী প্রধান ইহতিমাম খান বিদ্রোহ দমন
করেন এবং অবশেষে শেখ হাবিবুল্লাহ নামক একজন মোঘল সেনাপতি কর্তৃক মজলিশ কুতুবকে
পরাজিত করার মাধ্যমে এই জেলার কর্তৃত্ব মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের ওপর
অর্পিত হয়। সুবেদার ইসলাম খান মোগল শাসন নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে
যশোহররাজ প্রতাপাদিত্যকে দমনের জন্য সেনাপতি গিয়াস খানকে অভিযান
পরিচালনার নির্দেশ দেন। নৌ-অধিপতি ইহতিমাম খান এবং সেনাপতি মির্জা নাথান এই
অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। প্রতাপাদ্যিতের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রতাপাদিত্য চরিত গ্রন্থানুসারে জানা যায়, রামানন্দ গুহ (রামচন্দ্র) এবং
তার তিন পুত্র ভবানন্দ, গুণানন্দ ও শিবানন্দ সুলাইমান কররানির আমলে (১৫৬৫-১৫৭২
খৃ.) উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শিবানন্দ কালক্রমে সুলাইমান
কররানীর প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদে আসীন হন। ভবানন্দের পুত্র জানকী বলভ তথা বসন্ত রায়কে রাজস্ব বিভাগের প্রধান করা হয়। ভবানন্দের আরেক পুত্র শ্রীহরি সুলাইমান কররানীর পুত্র ও উত্তরাধিকারী দাউদ
কররানীর (১৫৭২-১৫৭৪ খৃ.) পরামর্শক পদে নির্বাচিত হন। কিন্তু দাউদ কররানীর পতন আসন্ন দেখে তারা তার পক্ষ ত্যাগ করেন এবং মেহেরপুর
অঞ্চল সহ বৃহত্তর কুষ্টিয়া যশোহর ও খুলনা জেলা নিয়ে গঠিত বিশাল এলাকা জুড়ে
নিজস্ব জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতাপাদিত্য ছিলেন দাউদ
কররানীর পরামর্শক শ্রীহরির পুত্র । এ অঞ্চলে মোগল অভিযানের
সময়কালে রাজা প্রতাপাদিত্য তার পৈত্রিক জায়গীরকে স্বাধীন
রাজ্যে পরিণত করেন। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় তবকাৎ-ই-আকবরী ও প্রত্যাপাদিত্য চরিত সূত্রে রাজা
প্রতাপাদিত্য প্রসঙ্গে উলেখ করেছেন , শ্রীধর বা শ্রীহরি নামক একজন বঙ্গবাসীর
পরামর্শে দাউদশাহ্ (সোলায়মান কররানীর পুত্র দাউদ কররানী) মিয়াঁ লোদী খাঁকে
বন্দী ও হত্যা করিয়াছিলেন। ইঁহার প্রকৃত নাম শ্রীহরি, ইনি বঙ্গজ কায়স্থ বংশজাত এবং
দাউদ শাহ ইঁহাকে বিক্রমাদিত্য উপাধি প্রদান করিয়াছেলেন। শ্রীহরি বা বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্য রায় পরে দক্ষিণবঙ্গে স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। রামরাম বসু-রচিত প্রতাপাদিত্য চরিতানুসারে শ্রীহরির
পিতার নাম ভবানন্দ এবং তাঁহার পিতামহের নাম রামচন্দ্র।”] মির্জা নাথানের সহযোগিতায় গিয়াস খান প্রতাপাদিত্যের
পুত্র তথা যশোহরবাহিনীর প্রধান রাজকুমার উদয়াদিত্যকে যশোরের সালিকা (শালিখা)-য়
পরাজিত ও আত্ম সমর্পণে বাধ্য করেন। আর এ ভাবে যশোহর রাজ্যও
পরিপূর্ণভাবে মোগল কর্তৃত্বে আসে। সেনাপতি গিয়াস খানকে নববিজিত
যশোহর রাজ্যের শাসন ভার অর্পণ করা হয়। মেহেরপুরও তার শাসনাধীনে চলে
যায়। ভবানন্দ মজুমদার ও নদীয়া রাজবংশঃ প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের এক
পর্যায়ে গিয়াস খান বাগোয়ানে উপনীত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার সহকারীদের সাথে অভিযান বিষয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করেন। এই বাগোয়ানেই মির্জা নাথানের সাথে বালভদ্র দাস নামক স্থানীয় এক হিন্দুর
পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা ঘটে। বালভদ্র প্রতাপাদিত্যের
বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে মির্জা নাথানকে সাহায্য করেন। মির্জা নাথান বালভদ্রের সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তার বকশী পদে আসীন করেন। অভিযান শেষে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পথে মির্জা নাথান তার নৌবহর ও
সৈন্য-সামন্ত সহ বাগোয়ানে শিবির স্থাপন করেন। সেখানে তিনি তার বিবাহ উৎসব উদযাপনে ব্যাপৃত হন এবং
নৌবহর ও সৈন্য-সামন্তের দায়িত্ব বালভদ্রের ওপর অর্পণ করেন। এই বালভদ্র দাসই পরবর্তীতে নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার নামে
প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ভবানন্দ প্রসঙ্গে অন্য বর্ণনায় জানা যায়, তিনি হুগলির শাসনকর্তা শাহ
ইসমাইলের কানুনগো পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানকে
যশোহর-রাজ প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে সহযোগিতার প্রতিদান হিসাবে
সম্রাট জাহাঙ্গির তাকে ভবানন্দ মজুমদার উপাধি ও বাগোয়ান পরগণার জায়গীর দান করেন। তার জমিদারিতে মোট চৌদ্দটি পরগণা ছিল, এর আয়তন ছিল তিন হাজার এক শ’ একান্ন বর্গমাইল। এই চৌদ্দটি পরগণার মধ্যে মহৎপুর পরগণাটি ছিল প্রসিদ্ধ অঞ্চল, এই পরগণার কেন্দ্রভূমি ছিল বাগোয়ান। বস্তুত বাগোয়ানই ছিল নদীয়া রাজ-বংশের রাজধানী। কূলগ্রন্থানুসারে তিন কায়স্থ ভ্রাতা, রামভদ্র মজুমদার, রামনাথ মজুমদার ও বাণীকান্ত
রায় হুসেইন শাহ-এর আমলে (১৪৯৩-১৫১৯ খৃ.) রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। তিনজনের মধ্যে বাণীকান্তকে হুসেন শাহ পদোন্নতি দিয়ে পরবর্তীকালে রায় রায়ান
পদে অধিষ্ঠিত করেন। এর ফলে বাণীকান্ত মেহেরপুর অঞ্চলে তার নিজ জমিদারি
প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সম্ভবতঃ বাগোয়ান কেন্দ্রিক
তার এই জমিদারিই ছিল মেহেরপুরের ইতিহাসে মেহেরপুরের ভৌগলিক সীমাবতী প্রথম
ভুমি-রাজস্ব ভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো। এ প্রসংগে সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তার মেহেরপুরের ইতিহাস
গ্রন্থে উলেখ করেছেন, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে মেহেরপুরের বাগোয়ানের
ভবানন্দ মজুমদার এক বিশাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ”নদীয়া রাজবংশ” নামে প্রতিষ্ঠ লাভ করে। নদীয়া রাজবংশ যে অঞ্চল নিয়ে জমিদারি কায়েম করে রাজ্য গড়ে তোলেন তা নদীয়া
নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সময় নদীয়া রাজ্যের জমিদারী এলাকা ছিল ৩,১৫১ বর্গ
মাইল। নদীয়া রাজ্যের প্রতিষ্টাতা ভবানন্দ মজুমদার হুগলীর
শাসনকর্তা শাহ ইসমাইলের বদ্যান্যতায় তার কানুনগো পদ লাভ করতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে প্রতাপাদিত্যের সাথে যুদ্ধে মির্জা নাথান ও মানসিংহকে সাহায্য
করার প্রতিদান স্বরূপ সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে ভবানন্দ মজুমদার উপাধি ও জায়গীর দান করেন। ভবানন্দের জমিদারিতে মোট ১৪ টি পরগনা ছিল। ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর রাজা রাঘব রায় নদীয়া রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত
করেন। স্থানটির অধিকাংশ অধিবাসী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসক
ছিলেন বিধায় রাঘব রায়ের পুত্র রুদ্র নারায়ণ স্থানটি কৃষ্ণনগর নামকরণ করেন। রুদ্রনারায়ণের পুত্র রামজীবন পিতার উত্তারাধিকারী হন। রামজীবনের পুত্র রঘুরাম এবং রঘুরামের পুত্র ইতিহাস প্রসিদ্ধ মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্র। নদীয়া রাজবংশের ইতিহাস প্রসঙ্গে Bangladesh District
Gazetteers Kushtia-র বর্ণনার সাথে মেহেরপুরের ইতিহাসের বর্ণনার ভিন্নতা
দেখা যায়। District Gazetteers-র বর্ণনানুসারে: Since
then ( অর্থাৎ ১৬০৮ (?) খৃষ্টাব্দে মির্জা নাথান প্রমুখ কর্তৃক অন্যান্য অঞ্চল
সহ মহতপৃর বাগোয়ান পরগণাকে মোগল শাসনাধীনে আনার পর থেকে।) the district (অর্থাৎ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা যার অধীনে মেহেরপুর একটি
মহকুমা ছিল) as a part of Jessore district, remained in charge of a Fauzdar
responsible to the Mughal Governor of Dacca. In 1696, during the Fauzdarship
of Nurullah Khan, Subha Sing and his successor Rahim Khan, living in Maharaja Krishna Chandra of Bagwan (Meherpur), a
successor of Maharaja Ramjiban, came to the gaddi in 1728, during the
viceroyalty of Shuja Khan (1727-1739). During the administration of Maharaja
Krishna Chandra Marhatta raids constantly oppressed the district and the
Maharaja was forced for a time to shift his headquarters to
Krishnanagar. ভবানন্দ মজুমদার ও নদীয়া রাজবংশের ইতিহাস প্রসঙ্গে
রজতকান্ত রায় তার পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ গ্রন্থে উলেখ করেছেনঃ ভবানন্দ
কুলীন ব্রাহ্মন ছিলেন না কিন্তু কৌলিন্য না থাকলেও সরকার সাতগাঁয়ের অস্থায়ী
কানুনগো পদ এবং পরগনা উখড়ার ক্রোরী পদ লাভ করে তিনি লক্ষ্মীর ঝাঁপী আয়ত্ত করতে
সক্ষম হয়েছিলেন। কথিত আছে রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে মোগল সেনাপতি
মানসিংহের অভিযানে যানবাহন ও খাদ্য সরবরাহ করে তিনি বাদশাহ জাহাঙ্গিরের সুনজরে
পড়েন এবং ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে বাদশাহী ফরমানের বলে চোদ্দটি পরগনার জমিদারী প্রাপ্ত
হন। এই ভাবে তার সৌভাগ্য রবি উদিত হলে পর ভবানন্দ বাগুয়ান থেকে (লোকে বলে এইখানে
মানসিংহ তার অতিথি হয়েছিলেন) মাটিয়ারীতে নিবাস উঠিয়ে নিয়ে যান এবং সেখানে তার
জ্যেষ্ঠ পুত্র গোপালের ঔরসে রাঘব রায়ের জন্ম হয়। রাঘব রায় মাটিয়ারী থেকে রেউই নামে এক মৃগ ময়ুর কাননাদি শোভিত মনোরম স্থানে
রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তখন সেখানে কয়েক ঘর গোপ ছাড়া
কেউ ছিল না, তারা ধুমধাম করে কৃষ্ণ পূজা করতো বলে তাঁর (রাঘবের) পুত্র রুদ্র রায় রেউই
নাম পরিবর্তন করে কৃষ্ণনগর নামকরণ করেন। ... রাঘব রায়ের কাল ... বাদশাহ
আওরঙ্গজেবের গোড়ার দিক- ঐ সময় নদীয়ার জমিদারী বিশালায়তন হয়ে রাজ্যের আকার ধারণ
করে। ভবানন্দ লোক সমক্ষে রায় মজুমদার বলে পরিচিত ছিলেন রাঘব রায় বাদশাহের সুবাহদারকে
নিয়মিত খাজনা দানে তুষ্ট করে মহারাজ উপাধি পেয়েছিলেন। রাজীবলোচন শর্মা (মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং
গ্রন্থের রচয়িতা) মহারাজ রাঘব রায়ের চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন- ‘ কতক কালানন্তরে রায় মজুমদার
(ভবানন্দ মজুমদার) তিন পুত্রের বিবাহ দিলেন কালক্রমে গোপাল রায়ের পুত্র হইল নাম রাখিলেন রাঘব রায়। ভবানন্দ রায় পৌত্র দর্শন করিয়া বিবেচনা করিলেন এ পৌত্র অতি প্রধান মনুষ্য
হইবেক সর্ব লক্ষণে লক্ষণাক্রান্ত।... পরে রাঘব রায় সর্ব শাস্ত্রে
গুণবান অতিবড় দাতা সর্ব্বদা যাবতীয় প্রজার প্রতিপালনে মতিমান সর্ব্ব
লক্ষণাক্রান্ত দান ধ্যান যোগ সদালাপ বিশিষ্টি লোকের সমাদর রাজ্য সুদ্ধ সকল লোকের
নিকট মহৎ সুখ্যাত্যাপন্ন জমিদারীর বাহুল্য হইতে লাগিল...।’ সমকালীন রচনা, কাব্য জীবনী ও তথ্য, থেকে মহারাজ রাঘব রায়
প্রজাহিতৈষী ছিলেন বলে জানা যায়। রাঘব রায়ের
পুত্র রুদ্র রায়ও পিতার মতো প্রজাহিতৈষী ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট Hedge
সাহেবের ডায়ারীতে ১৬৮২ খ্রীস্টাব্দের অক্টোবর মাসের রোজনামচায় দেখা যায়-
“ভোর বেলা শ্রীনগর গ্রাম পার হয়ে বিকেল বেলা পাঁচটা নাগাদ আমরা রেউই পৌঁছে গেলাম। এই গ্রামের মালিক হলেন উদয় (রুদ্র ,অপভ্রংশে- উদ্র
> উদয়) রায় নামে এক জমিদার যিনি প্রায় হুগলীর অপর পার
পর্যন্ত গঙ্গার এই ধারের সমস্ত দেশের মালিক। রাঘব রায়ের কাল থেকে রেউইয়ের চারপাশে পরিখা কাটা ছিল, রুদ্র রায়
একটি খাল কেটে তার সাথে সংযোগ স্থাপন করে সেই জায়গার নাম দেন কৃষ্ণনগর এবং সেখান
থেকে শান্তিপুর পর্যন্ত প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণ করেন। রুদ্র রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্র - জ্যেষ্ঠা
মহিষীর গর্ভজাত রামচন্দ্র ও রামজীবন এবং কনিষ্ঠা মহিষীর গর্ভজাত রামকৃষ্ণ
পরস্পরের সঙ্গে উত্তারাধিকার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করায় তাদের জমিদারী
নবাব সরকারের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বশবর্তী হয়ে পড়ে এবং এক এক বার এক এক জন
খাজনার দায়ে বা পরস্পরের কুটচালে ঢাকায় বা পরে মুর্শিদাবাদে আটক হতে থাকেন। কনিষ্ঠার গর্ভজাত রামকৃষ্ণকে রাজা রুদ্র রায় উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গেলেও
হুগলীর ফৌজদার ও ঢাকার নাজিমের আজ্ঞাক্রমে জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্র প্রথমে জমিদারীতে
নিযুক্ত হন কিন্তু সহোদর রামজীবন তাঁকে হটিয়ে দেন, পরে আবার রামচন্দ্র নিজের ভাইকে বিতাড়ন করে রাজ্য দখল
করেন। শীঘ্রই তাঁর মৃত্যু হওয়ায় রামজীবন আবার রাজা হয়ে বসেন
কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই বৈমাত্রেয় ভাই রামকৃষ্ণের ষড়যন্ত্রে ঢাকায় বন্দী হন। এভাবে কৌশল-পাল্টা-কৌশলের মধ্য দিয়ে অবশেষে রামকৃষ্ণ নদীয়ার জমিদারীতে
অধিষ্ঠিত হন। রামকৃষ্ণ রায়ের কৃতিত্ব ও সাফল্য বিষয়ে রাজীব লোচন
শর্মার বর্ণনা- “রামকৃষ্ণ মহারাজ পরমধার্ম্মিক এবং সুবার নিকট যথেষ্ট মর্যাদান্বিত (প্রজাদের
ওপর) যে রাজকর পূর্বে নির্ধারিত ছিল তাহা অপেক্ষা কিছু অল্প করিয়া যথেষ্ট সৈন্য
রাখিয়া রাজ্যের বাহুল্য করিলেন। রামকৃষ্ণ মহারাজ বাইশ লক্ষের
জমিদারী করিয়া পরম সুখে কালযাপন করেন। তাহার অবর্তমানে রামজীবন
(জ্যেষ্ঠ ভাই) রায় রাজা হইলেন। বিদ্রোহদমন উপলক্ষে বাদশাহজাদা আজিম-উশ-শান বাংলার
সুবাহদার হয়ে এলে রামকৃষ্ণ তাঁকে সৈন্য সহায়তা দেওয়ায় তিনি রামকৃষ্ণের ওপর
বিশেষভাবে প্রীত হয়েছিলেন। তবে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর
সাথে আজিম-উশ-শানের বিবাদ হওয়ায় খাজনার দায়ে রামকৃষ্ণ আটক হন এবং বসন্তরোগে ভুগে
অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। আজিম-উশ-শানের উদ্যোগে
রামকৃষ্ণের উপযুক্ত উত্তরাধিকারী অনুসন্ধানে কারারুদ্ধ রামজীবনের সন্ধান পাওয়া
গেলো। তাকেই জমিদারীতে অধিষ্ঠিত করা হলো। কিন্তু রামজীবন তার স্বভাবসুলভ উচ্ছৃংখলতার কারণে কর পরিশোধে অবহেলার ফলশ্রুতিতে
মুর্শিদাবাদের কারাগারে আবার আটক হলেন। রামজীবনের পুত্র রঘুরাম রায়
রাজশাহীর বিদ্রোহী জমিদার উদয় নারায়ণের সেনাপতিকে শর-যুদ্ধে হত্যা করে
পিতৃ-মুক্তি অর্জন করেন। রামজীবনের মৃত্যুর পর তার
উক্ত পুত্র রঘুরাম রায় নদীয়ার জমিদার হন। ১৭১০ খৃ. রঘুরাম রায়ের একটি
পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। ‘ব্রাহ্মণেরা
বেদধ্বনি করিতে লাগিলেন। পরে
জ্যোতিষী ভট্টাচার্য্যেরা নানা শাস্ত্র বিচার করিয়া দেখিলেন অপূর্ব বালক হইয়ছে। রাজার নিকট নিবেদন করিলেন, মহারাজ এই
যে রাজপুত্র হইয়াছেন ইহার দীর্ঘ পরমায়ু হইবেক, সর্ব
শাস্ত্রে মহমহোপাধ্যায় এবং বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায় এবং ধর্মাত্মা হইবেন। সকল লোক ইহার অতিশয় যশ ঘুষিবেক । মহারাজচক্রবর্ত্তী হইয় বহুকাল রাজ্য করিবেন। মহারাজ ইহার গুণে কুল উজ্জ্বল হইবেক। রাজা
জ্যোতিষী ভট্টাচার্য্যদের বাক্য শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত হর্ষযুক্ত হইলেন। ... রাজপুত্র দিনে ২ চন্দ্রের ন্যায় বৃদ্ধি পাইতেছেন নাম
রাখিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। কালক্রমে
বিদ্যা অভ্যাস করিতে প্রবর্ত্ত হইলেন,..’ । ১৭২৮ খৃ. রঘুরাম রায় মৃত্যু বরণ করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের বয়স তখন ১৮ বছর মাত্র। সেই বয়সেই তাঁর কুট কৌশল এবং স্বীয় অভীষ্ট সাধনে চাতুর্যের পরিচয়
পাওয়া যায়। কথিত আছে কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা অজ্ঞাত কারণ বশতঃ তাকে
উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে তার পিতৃব্য রামগোপালকে উত্তরাধিকার দিয়ে যান। কৌশলী কৃষ্ণচন্দ্র পিতৃব্যকে পথিমধ্যে তামাক সেবনে নিরত রেখে নবাবের দরবারে
হাজির হয়ে নিজের নামে জমিদারী সনদ হাসিল করেন। লোক মুখজাত এই তথ্যের কোন ঐতিহাসিক সূত্র পাওয়া না গেলেও এটি রাজা
কৃষ্ণচন্দ্রের চরিত্রের একটি মৌলিক বৈশিষ্টের ইঙ্গিত দেয়। রাজাকৃষ্ণচন্দ্র রায় তার সমগ্র জমিদারী কালে সমসাময়িক কালের অন্যতম কুটকৌশলী
হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। নদীয়া রাজবংশের পরবর্তী
কাহিনী মেহেরপুরের ইতিহাসের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত কোন দিক
নির্দেশনা পাওয়া যায় না । ইতিহাসের ধারা লক্ষ্য করলে
দেখা যায় ১৭৫০ সালের পর বাগোয়ান পরগণার একাংশ অথাৎ ভৈরবনদের পশ্চিম তীরস্থ
অংশটি রাজাপুর পরগণা নামে নতুন ভাবে পরিচিত হয় এবং তা নিষ্কর হওয়ার সম্ভাবনাই
বেশী। সুতরাং নদীয়া রাজবংশের সাথে ঐ পরগণা তথা মেহেরপুরের
সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যায় কারণ স্বয়ং নবাব যখন তা রাজুগোয়ালিনীকে দান করেছেন সেখান থেকে
খাজনা দাবী করা বা কর্তৃত্ব বজায় রাখা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের পক্ষে সম্ভব
ছিলনা। নদীয়া রাজবংশের প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টানা হচ্ছে। পরবর্তীতে বাগোয়ান ও নব সৃষ্ট রাজপুর পরগণা নাটোরের রাণী ভবানীর কর্তৃত্বে কিভাবে চলে যায় তার
সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। মেহেরপুর শহরের প্রতিষ্ঠাঃ মেহেরপুর শহর তুলনামূলকভাবে অনেক নবীন একথার তাৎপর্য এই নয় যে জনপদ হিসেবেও মেহেরপুর নতুন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় মেহেরপুর একটি অতি প্রাচীন লোকাবাস। মেহেরপুরের আদি নাম কি ছিল তা আজ আর জানার কোন উপায় নেই। এই গ্রামটি বাগোয়ান পরগণার একটি লোকালয় ছিল। অনুমান করা যায় শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত সদগোপ এবং মৎসজীবীদের কোন শাখার বসতি ছিল
এই গ্রামে । তবে সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ইসলাম তার মেহেরপুরের ইতিহাস
গ্রন্থে এখানে কোন জন বসতি ছিল না বলে অনুমান করেছেন। তার এ অনুমান সমর্থনযোগ্য নয়। নদীতটস্থ উর্বর একটি
মৃত্তিকায় জনবসতি গড়ে ওঠাই নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। বসতি স্থাপনের প্রধান অন্তরায়
হিংস্র পশু ও সরীসৃপাদি উপদ্রুত কণ্টাকীর্ণ বিশালায়তন বনাঞ্চল। মেহেরপুরে এধরনের কোন বিশালায়তনের বনাঞ্চলের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ পাওয়া
যায় না। বরং ভৈরবনদ তীরবর্তী উর্বর শ্যামল ভূমি এবং মৎসাদি আহরণের সহজ উৎস থাকায় এখানে গোপালক এবং ধীবরদের জনবসতি গড়ে ওঠার
সম্ভাবনাই প্রবল। তবে যারা এখানে জনবসতি গড়ে তুলেছিলেন নিঃসন্দেহে তারা
ছিলেন সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ, তাদের গৃহাদির মতোই তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক
কাঠামোটিও (Socio-cultural
structure) ছিল নিতান্ত ভঙ্গুর তাই
সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে তাদের প্রতিষ্ঠানাদিও মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মেহেরপুর শহরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৫০ সালের পরে। ইতিহাস অনুসারে ঐ বছর নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ বাগোয়ানে মৃগয়া শেষে মুর্শিদাবাদ
ফেরার পথে ভৈরবনদে ঝঞ্ঝাক্রান্ত হয়ে রাজুগোয়ালিনির আশ্রয় গ্রহন করেন এবং রাজুর
আতিথ্যে প্রীত হয়ে তার যাচঞা অনুযায়ী তাকে ভৈরবনদের পশ্চিমতটস্থ সমুদয় ভূমি দান
করেন। এই ভূমির নামকরণ করা হয় রাজপুর। এই রাজা গোয়ালা চৌধুরী খেতাব প্রাপ্ত রাজুর পুত্র মেহেরপুর শহরের গোড়াপত্তন
করেন। District Gazetteers অনুসারেঃ [Establishment
of Meherpur town:] In 1750, Alibardi Khan, the governor of the province,
came to Bagwan with a Shikar party. One evening during the return voyage
along the river Bhairab, a tornado raged furiously and sank some of his
boats. The journey had to be abandoned and the Nawab and his men took shelter
in a house of a milk-maid, a widow named Raju Ghosani. The widow looked after
the comforts of the Nawab and served him and his chira, curd gur and bananas.
The Nawab was very much pleased with the humble service of this widow and
enquired what reward suits her. Raju Ghosani prayed for the granting of a
grazing field for her 100 cattle. The noble Nawab, at once, granted her the
entire portion of the pargana Bagwan that lies on the eastern side of the
river Bhairab. The Nawab named this portion of the pargana Bagwan as (pargana) Rajpur after the name of Raju Ghosani.
The son of the widow was granted the title of Raja Goala Chowdhury. This Raja
developed Meherpur, which grew into a prosperous town. The riches of Meherpur
soon attracted the attention of the greedy Marhatta plunderers, who ransacked
the town on several occasions. Their brutality and cruelty ruined Meherpur.
Being defeated again and again, the Raja and his nobles constructed secret
hide-outs wherein they could take shelter at the time of raids. এ প্রসঙ্গে ১৩১৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত কুমুদনাথ মল্লিক
রচিত নদীয়া কাহিনী পাঠে জানা যায় : বহু পূর্ব্বে মেহেরপুরে গোয়ালাচৌধুরী উপাধী-ভূষিত
সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তিগন বাস করিতেন; ইঁহাদের প্রধান ছিলেন রাজা রাঘবেন্দ্র ও রাজুঘোষাণী
(ইহার নাম হইতে রাজপুর পরগণার নাম হইয়াছে।) তাঁহাদের স্বাক্ষরিত সনদ, কোবালা , দানপত্র প্রভৃতি দলিলাদি অনেক গৃহস্থের ঘরে আছে। কথিত আছে বর্গীর হাঙ্গামাকালে মহারাষ্ট্রগণের অন্যতম নেতা রঘুজি ভোঁসালার সহিত যুদ্ধে
এই বংশীয়েরা সপরিবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েন। চৌধুরীদিগের নিধনের পর বহুদিন
তাঁহাদের অধিকৃত মেহেরপুরের অন্তর্গত প্রাসাদোপম অট্টালিকাদি ক্রোশৈকদূরস্থ
সুবিস্তীর্ণ গড়ভূমি, দীর্ঘিকা ইত্যাদি বনাকীর্ণ হইয়া ছিল, এবং প্রয়োজন হইলেও কেহ কখন
ইহার ইষ্টকাদি ব্যবহার করিত না। সাধারণের মনে ইহাই দৃঢ়
সংস্কার ছিল যে, চৌধুরী বংশের ইষ্টকাদি লইলে কাহারও শুভ হয় না; কিন্তু ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে এখানে মিউনিসিপালটী স্থাপিত
হইলে এই আবাসভূমির মধ্যেই মিউনিসিপাল আপিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, পোষ্টাফিস, জমীদারী কাছারি এবং দুই এক ঘর গৃহস্থেরও বাটী
নির্ম্মিত হইয়াছে। দীর্ঘিকাটি মিউনিসিপালিটি কর্তৃক পুনঃসংস্কৃত হইয়া
পানীয় জলের নিমিত্ত ব্যবহৃত হইতেছে। বর্তমান কালে এই আবাস বাটির
অনতিদূরে একটি সুগঠিত প্রাচীন শিবমন্দির এবং গোয়ালা চৌধুরীদিগের একটি কালীমন্দির
আজিও বিদ্যমান আছে। প্রাতঃস্মরণীয় রাণী ভবানী যখন রাজপুর পরগণার অধিকারিণী
হয়েন, তখন মেহেরপুরেরও তিনি অধিশ্বরী হয়েন। রাণী ভবানীর হস্ত হইতে
মেহেরপুর কাশিমবাজারাধিপতি হরিণাথ কুমারের হস্তে আসে। পরে (১৮৪১ খৃ.?) হরিনাথের পুত্র রাজা কৃষ্ণনাথ এই ডিহি মেহেরপুর James Hill নামক এই দোর্দণ্ড প্রতাপ
নিলকুঠিয়ালকে পত্তনী দেন। ইংরেজ শাসনে মেহেরপুর ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল বাংলা তো বটেই সমগ্র
ভারত বর্ষের জন্য একটি ইতিহাস নির্মাণকারী ও ইতিহাসের গতি নির্ধারণকারী ঘটনা
হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। নদীয়ার জমিদার রাজা
কৃষ্ণচন্দ্র পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের পক্ষালম্বন
করে এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের ‘দালালি’র
পদাঙ্কই অনুসরণ করেন। ভবানন্দ মজুমদার যশোহর-রাজ প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে
পরিচালিত যুদ্ধে মোগলদের সাহায্য করেই বাগোয়ান পরগনার জমিদারি তথা নদীয়া রাজ বংশ
প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার
নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্লাইভকে সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে রাজা রাজেন্দ্র
বাহাদুর খেতাব লাভ করেন। পলাশীর ষড়যন্ত্র ও আমঝুপি কুঠিবাড়ীর গপ্পঃ নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত অনেকগুলো
ষড়যন্ত্রের একটি বা সর্বশেষটি মেহেরপুরের সন্নিকটে আমঝুপি কুঠিবাড়িতে অনুষ্ঠিত
হয় বলে একটি অপপ্রচার সমপ্রতি প্রচলন করা হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা ইতিহাস সমর্থিত নয়। সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তার
মেহেরপুরের ইতিহাস গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উলেখ করেছেনঃ আমঝুপি নীলকুঠিকে নিয়ে একটি
বিকৃত ইতিহাসের অবতারণা করা হয়েছে যা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন । আমঝুপি নীলকুঠি নীলকরদের শত অত্যাচারের একটি ঐতিহাসিক স্থান। একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা, নীলকুঠিয়াল মিকেনী, সিম্পসন, ফার্গুসেন, জেমস হিল এদের আনন্দের হোলি আর কৃষকদের নির্যাতিত
হওয়ার কাহিনী আমঝুপি নীলকুঠির আকাশে-বাতাসে এখনো জড়িয়ে আছে। এই ঐতিহাসিক ্স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমঝুপি নীলকুঠির ইতিহাসকে বিকৃত করে তার ললাটে এক কলংকের
ইতিহাস লেপন করে দেওয়া হয়েছে। আমঝুপি নীলকুঠির দেয়ালের গায়ে বিকৃত ইতিহাসের যে শিলালিপি প্রতিস্থাপিত
হয়েছে তা হবহু তুলে ধরছি আলোচ্য বিষয়টি সহজতর করার জন্যঃ “ “আমাদের ইতিহাসের সোনালী স্মৃতি” ইতিহাস একটি জাতির জীবনের ধারাবাহিক চলচ্চিত্র এবং এর
সভ্যতার স্মারক। মৌন অতীতকে সে মানুষের কাছে বাগময় করে তোলে নির্মোহ
নিরপেক্ষতায় । ইতিহাস তাই গৌরব গর্ব ও কলংকদায়ক একসুত্রে গেঁথে
প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই ইতিহাসের সড়ক বেয়েই
মানুষের চিরকালের যাওয়া ুআসা, প্রবাহমান জীবন স্রোত এমনি করে বয়ে চলে কাল থেকে
কালান্তরে। ইতিহাসের এমনি এক ধূসর পথে সীমান্ত শহর মেহেরপুরের কোল
ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমঝুপি। এই পথে একদিন মোগল সেনাপতি
মানসিংহের বিজয় রথ ছুটেছে। এই পথে ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গী
দল ধূলি উড়িয়ে গেছে লুণ্ঠনের কালো হাত বাড়িয়ে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃগয়ার স্মৃতিও রয়েছে এই
খানে। পলাশীর পরাজয়ের নীলনক্সাও রচিত হয়েছিল এইখানে- এই
আমঝুপিতে। জনশ্রুতি আছে যে, এইখানেই রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে মীরজাফর ও ষড়যন্ত্রকারীদের শেষ বৈঠক হয়েছিল এবং
তার ফলে শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলারই ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেনি, বাঙালী হারিয়েছিল তার স্বাধীনতা ইংরেজ আমলের সূচনাপর্বে বাংলার নির্যাতিত মানুষের নীল
রং রক্তে গড়ে ওঠে আমঝুপি নীলকুঠি। কুঠিয়াল কেনী সিম্পসন, ফার্গুসেন সতীর্থদের অত্যাচার
নির্যাতন শোষণের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুঠি-আমঝুপি। নির্যাতিত নীলচাষীর দুর্বার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে একদিন বাংলার বুক থেকে
নিশ্চিহ্ন হলো নীলচাষ। হাত বদল হয়ে আমঝুপি নীলকুঠি মেদিনীপুর জমিদারী
কোম্পানীর কাচারীতে পরিণত হলো। দেশভাগের পর জমিদারী উচ্ছেদের
সঙ্গে সঙ্গে সে অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটলো। বিবর্তনের ধারা বেয়ে আরেক ইতিহাসের জন্ম হলো ১৯৭৮
সালের ১৩ই মে, খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের আমঝুপি অধিবেশনে। এই ইতিহাস অতীতের শোষণ-বঞ্চনা নির্যাতনের স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে মানুষের মনে
শ্রম প্রগতির পথে অভিযাত্রার ইতিহাস। এই সভায় আমঝুপি স্বীকৃতি পেল পর্যটন কেন্দ্ররূপে। ১৮০২০০০ (আঠার লাখ দুই হাজার ) টাকা ব্যয়ে আমঝুপি কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এলাকায়
আমঝুপি নামের বিলীয়মান স্মৃতিকে পুনর্জাগ্রত করার প্রয়াসে আম্রকানন স্মৃতিসহ
একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের প্রকল্প গৃহীত হয়। ইতিহাসের আরেক কালান্তরে আমঝুপি আবার গৌরব ও স্বীকৃতির
শিরোপা লাভ করলো। তার এই আলোকাভিসার আজ যদি ইতিহাসের সরণি বেয়ে স্বকাল
ও ভাবীকালের মানুষকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে তবেই তার এই
পুনর্জন্ম সার্থক হবে-সফল হবে এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও পরিকল্পকদের শ্রম ও সংকল্প। ২৬ শে মার্চ, ১৯৭৯- আব্দুল মান্নান ভূইয়া জেলা প্রশাসক, কুষ্টিয়া।” সৈয়দ
আমিনুল ইসলাম উক্ত ফলকে লিপিবদ্ধ ইতিহাস বিকৃতির
প্রতিবাদ করেছেন। উলেখ্য, এই নীলকুঠিসহ বাংলার সকল নীলকুঠীর প্রতিষ্ঠা হয় পলাশীর
যুদ্ধের অনেক পরে অন্ততঃ কুড়ি বছর পরে। আমিনুল ইসলামের মতে, লুই বর্মো নামের জনৈক ফরাসী
নীলকুঠিয়াল ১৭৭৭ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম নীলকুঠী স্থাপন করে। আর ইংরেজদের মধ্যে ক্যারেল বুম নামক জনৈক ব্যক্তি ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে বাংলার
নদীয়া জেলায় প্রথম নীলচাষের উদ্যোগ নেন এবং নীলকুঠি স্থাপন করেন। প্রকৃত পক্ষেই চন্দননগর নিবাসী ফরাসী ঔপনিবেশিক Louis Bonnaud ১৭৭৭ সালে এদেশে সর্বপ্রথম
নীলচাষ ও নীলের ব্যবসায় শুরু করেন। (সূত্রঃ DISCOVER CHANDERNAGORE
by Dr. Ajit Kumar Mukhopadhay & Kalyan Chakrabortty: From Internet). ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা
নীলগাছের চাষ ও নীল উৎপাদন ও বিপণন ব্যতীত অন্য কোন কারণে নীলচাষ প্রচলনের
পূর্বকালে আমঝুপিতে কোন কুঠি স্থাপনের কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। এমনকি কোন সম্ভাবনার অনুমানেরও ভিত্তি নেই। বস্তুতঃ সমগ্র মেহেরপুর জেলার কোথাও (এমন কি মেহেরপুর শহর বা বাগোয়ান পরগণার
অন্য কোন স্থানে) নীল চাষ ও নীলের ব্যবসায় শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোন ইংরেজ
কুঠি নির্মিত হয়নি। সমসাময়িক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ইংরেজদের কুঠি যাকে তারা
গালভরা বুলিতে Fort
বলতো সেগুলি ছিল প্রধানতঃ ঢাকা, কলকাতা, চন্দননগর, কাটোয়া, কাশিমবাজার প্রভৃতি বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে। স্মরণ রাখা উচিৎ ইংরেজ বণিকদের রাজ্যাভিলাষ ছিলো না, নিরুপদ্রবে সর্বাধিক হারে লাভ
প্রদানকারী বাণিজ্যের প্রতিই তাদের মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। তারা নিজস্ব সৈন্য বাহিনী গড়ে তুলেছিল নিরাপদ বাণিজ্য যাত্রা এবং ধনসম্পদ
রক্ষার জন্য। প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই রাজ্যলাভের সুযোগ তারা হাতে
পেয়ে তার সর্বোত্তম সদ্ব্যাবহার করেছে মাত্র। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে . House of Commons-এ রবার্ট ক্লাইভের ভাষণের নিম্নোদ্ধৃত অংশ থেকেঃ Let the House figure to itself a country
consisting of 15 millions of inhabitants, a revenue
of four millions sterling, and a trade in proportion. By progressive steps
the Company have become sovereigns of that empire. Can
it be supposed that their servants (অর্থাৎ কোম্পানির বেতনভূক কর্মচারী) will refrain from
advantages so obviously resulting from their situation? (সূত্র: Robert Clive: Speech in
Commons on এখানে Situation বলতে রাজ্য জয়ের সহজ সুযোগের কথাই ক্লাইভ বলেছেন। সুতরাং সহজেই বোঝা যাচ্ছে প্রধান প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোথাও
কুঠি স্থাপনের কোন সম্ভাবনাই ছিল না পলাশী যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত। সুতরাং পলাশী যুদ্ধের পূর্বকালে আমঝুপিতে নীল কুঠি বা কোন প্রকারের ইংরেজ
কুঠির অনুমান করা এবং সেই কুঠিতে ক্লাইভ-মীরজাফরের ষড়যন্ত্র কল্পনা করা নিতান্ত
অবিমৃষ্যকারিতা। আমঝুপি কুঠিবাড়িতে কোন ষড়যন্ত্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল
ইতিহাসে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এমনকি রবার্ট ক্লাইভও তার কোন রিপোর্ট, চিঠি বা ডাইরিতেও এ বিষয়ে কোন
কিছু উলেখ করেন নি। তার বিভিন্ন সময়ের রিপোর্ট ও বৃটিশ সংসদে প্রদত্ত
বক্তব্যাদিতেও আমঝুপি বা মেহেরপুর বা নদীয়ার কোন স্থানে কোন গোপন বৈঠক হয়েছিল
এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে মীর
জাফর প্রমুখের সাথে রবার্ট ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ক্লাইভ স্বীকার করেছেন তার এই রিপোর্টেঃ About this time some of his principal officers
made overtures to us for dethroning him. At the head of these was Meer
Jaffier, then Bukhshee to the army, a man as generally esteemed, as the other
was detested. As we had reason to believe this disaffectionate pretty
general, we soon entered into engagements with Meer Jaffier to put the crown
on his head. All necessary preparations being completed with the utmost
secrecy, the army, consisting of about one thousand Europeans and two
thousand sepoys, with eight pieces of cannon, marched from Chandernagore on
the 13th and arrived on the 18th at Cutwa Fort. The 22nd, in the evening, we
crossed the river, and landing on the island, marched straight for Plassey
Grove, where we arrived by one in the morning. [Letter written on 26 July
1757 by Robert Clive to the East India Company on the Battle of Plassey.] ক্লাইভের এই engagements with Meer
Jaffier-with utmost secrecy কিভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা কিন্তু ক্লাইভ উলেখ করেননি। তবে তার সাথে ক্লাইভের এ বিষয়ে কখনও কোনস্থানেই সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি । তাদের মধ্যে দুতিয়ালির কাজ করেছিলেন ওয়াটস, স্ক্র্যাফটন, রায় দুল্র্ভ, খোজা পেত্রস, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কালী প্রসাদ প্রমুখ। কিন্তু তাদের এই দুতিয়ালি কোন ধারাবাহিক কার্যক্রম ছিলনা। পলাশীর ষড়যন্ত্র কোন একটি বৈঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল
না । এর কালিক, ভৌগলিক এবং স্বার্থগোষ্ঠীগত বিস্তৃতি ছিল বহুমাত্রিক। এর উৎস মুর্শিদাবাদের নবাব দরবার। এই দরবার সংশিষ্ট আমির-ওমরাহ, জমিদারবর্গ এবং নানাদেশীয় শেঠ-সওদাগর প্রভৃতি শ্রেণী
সংশিষ্ট ছিল এই ষড়যন্ত্রে। এই ষড়যন্ত্র বিষয়ে বিস্তারিত
বর্ণনা আছে রজতকান্ত রায়ের পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ গ্রন্থে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ষড়যন্ত্রের চরম রূপ লাভ ঘটে
পলাশীর আম্রকাননে। পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধের যে অভিনয় হবে তার চিত্রনাট্য
আগেই লিপিবদ্ধ হয়। এই চিত্রনাট্য কোন একটি অধিবেশনে লেখা হয়নি। সবার ভুমিকাও একদিনে নির্ধারণ করা হয় নি। তাই আমঝুপির কুঠিবাড়ির প্রস্তর ফলকে যারা লিখে রেখেছেন এখানে শেষ বৈঠক
অনুষ্ঠিত হয় তারা নিতান্ত ভ্রান্তি বশতঃ এই উক্তি করেছেন। পলাশীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্যের কোন প্রাথমিক সুত্র পাওয়া না যাওয়ায়
রজতকান্ত রায় ষড়যন্ত্রকারীদের চিঠিপত্রের ভিত্তিতে একটি ধারা বিবরণি তৈরি করেছেন। তাতে এমন কোন উলেখ নেই যে, ষড়যন্ত্রকারীরা
মুর্শিদাবাদ-পলাশী-কলকাতা-কাসিমবাজার-চন্দননগরের বাইরে কোন স্থানে কখনও কোন বৈঠক
করেছেন। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ষড়যন্ত্রে সংশিষ্ট
ছিলেন। তার সংশিষ্টতার জন্য হয়তো কেউ অনুমান করে থাকতে পারেন
আমঝুপির কুঠিবাড়িটি তার রাজ্যাধীনে হওয়ায় তার ব্যবস্থাপনায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ধারনাটিও ভ্রান্ত। ১৭৫০ সালের পর অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের কালে এই অঞ্চল তার জমিদারি বহির্ভূত ছিল। কারণ নবাব আলীবর্দি খাঁ এই অঞ্চল রাজুগোয়ালিনীকে দান করেছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই নবাবদত্ত
পরগণাতে কোন মধ্যবর্তী জমিদার প্রভৃতি থাকতে পারে না। তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য
মুর্শিদাবাদ গেছেন। এর সত্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায় রাজীব লোচন শর্মার মহারাজা
কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং গ্রন্থেঃ ‘শেষে এই পরামর্শ হইল যাহাতে জবন (নবাব)
দূর হয় তাহার চেষ্টা করহ ইহাতে জগৎসেঠ কহিলেন এক কার্য্য করহ নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
রায় অতিবড় বুদ্ধিমান তাঁহাকে আনিতে দূত পাঠাও তিনি আইলেই যে পরামর্শ হয় তাহাই
করিব। ... পরে এক দিবস জগৎ সেঠের বাটীতে রাজা মহেন্দ্র (রায় দূর্লভ) প্রভৃতি
সকলে বসিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে আহ্বান করিলেন দূত আসিয়া রাজাকে লইয়া গেল
যথাযোগ্য স্থানে সকলে বসিলেন।’ রাজীবলোচনের বর্ণানুসারে কৃষ্ণকচন্দ্র কলকাতায় গিয়ে
সাহেবদের সঙ্গে যোগসাজশ করলেন এবং তার ফলে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়ে মীর
জাফরকে মসনদে স্থাপন করল। রাজীবলোচনের বর্ণনা অতি
সরলীকরণ ও কল্পনাবাহুল্য দোষে দুষ্ট বলে তার গ্রন্থটিকে বিশুদ্ধ ইতিহাসের
মর্যাদা দেওয়া যায় না বলে রজত রায় মন্তব্য করেছেন। এই ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের অনেকেই
শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে সামিল থাকতে পারেননি। ষড়যন্ত্রের চুড়ান্ত পর্যায়ে যারা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলে তারা হলেন- মীর
জাফর আলী খান, রাজা রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ খান, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ মাহতাব রায়, কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, লিউক স্ক্রাফটন, ওয়াটস, খোজা ওয়াজিদ, খোজা পেত্রস, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুদার প্রমুখ। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম সারির কেউ সরাসরি কোন বৈঠক করার মতো কোন ফুরসত পাননি। নবাবের কিছু বিশ্বস্ত চর সব সময়ই তাদের ওপর নজরদারী করতো এবং তাদের
প্রতিদিনকার কার্যক্রম নবাবের কাছে হাজির করা হতো। ষড়যন্ত্রের মূল কলকাঠি ছিল নবাব দরবারে উপস্থিত ইংরেজ কোম্পানীর দূত ওয়াটসের
হাতে । তিনি প্রতি নিয়ত দরবারের অভ্যন্তরের ঘটনাপ্রবাহ ক্লাইভ
জানাতে থাকেন। দরবারের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস
জন্মে যে সিরাজ-উদ্দৌলার পরিবর্তে একজন নতুন নবাব পেতে দরবারের দরবারীরা খুবই
উদগ্রীব। এই পরিস্থতির প্রেক্ষাপটে পলাশীর ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক
একটি চিত্র তুলে ধরা হলঃ (এই ধারাবাহিক বয়ানটি রচনায় সম্পূর্ণরূপে রজতকান্ত
রায়ের দীর্ঘ গবেষণালব্ধ তথ্যবহুল মুল্যবান ও এ বিষয়ে একটি আকর গ্রন্থ পলাশীর
ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ-এর অনুসরণ করা হয়েছে। আমি গ্রন্থটি ব্যাবহার করার জন্য তাঁর কাছে অকৃত্রিম ঋণ স্বীকার করছি। -ওয়েবপেজ এডিটর) ১৭৫৭ সালের ৮ই এপ্রিল ঢাকার কুঠিয়াল স্ক্র্যাফটন
(কলকাতায় রবার্ট ক্লাইভের সাথে সাক্ষাৎ করে) মুর্শিদাবাদে আসেন ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে। তার কাছ থেকে ওয়াটস জানতে পারেন রবার্ট ক্লাইভের প্রত্যাশা মুর্শিদাবাদের
নবাব পদে নতুন কাউকে বসানো যায় কিনা সে ব্যাপারে তিনি ও ওয়াটস যেন খোঁজ খবর নেন। সেই নির্দেশ মতে তারা উমিচাঁদ ও জগৎশেঠের মাধ্যমে সম্ভাব্য সকলের সাথে গোপনে যোগাযোগ করতে
থাকেন। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম মনোনয়ন ছিল সেনাপতি মীর খুদা
ইয়ার লতিফ খান। কিন্তু মীরজাফর আলী খান তাকে সমর্থন না করায় তার
মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। ২৪শে এপ্রিল আরমানি সওদাগর খোজা পেত্রসের মাধ্যমে
মীরজাফর আলী খান অত্যন্ত গোপনে ওয়াটসকে একটি বার্তা পাঠান তার মূল বক্তব্য হলো “ ক্লাইভ যদি রাজী থাকেন তবে
আমি নিজে, রহিম খান, রায় দূর্লভ আর বাহাদুর আলী এবং আরো কেউ কেউ তৈরী আছি তার সাথে সামিল হয়ে
নবাবকে গ্রেফতার করে যাকে পছন্দ এমন আর কাউকে নবাবীতে আসীন করবো।” ওয়াটস মীরজাফরের এই প্রস্তাবে সুপারিশ করে বিবেচনার জন্য রবার্ট ক্লাইভের
কাছে পাঠিয়ে তার জবাবের অপেক্ষা করতে থাকেন। ১লা মে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কুঠিতে মীরজাফর আলীর
প্রস্তাব বিষয়ে বৈঠক বসলো। বৈঠকে মীর জাফরের প্রস্তাব এই
বিবেচনায় গৃহীত হলো যে, নবাব মহলের অভ্যন্তরে যে অবস্থা তাদের মতে, The Nabob is so hated by
all sorts and degrees of men; the affection of the army is so much alienated
by him for his ill usage of the officers, and a revolution (i.e. change over বা পরিবর্তন) so generally wished for, that it is probable that the step (of dethroning
Siraj) will be attempted ( and successfully too) whether we give our
assistance or not. যেহেতু এমনিতেই ঘটনাটা ঘটে যাবে তখন বিজয়ীপক্ষকে করায়ত্ত করার এই সুযোগ হাত
ছাড়া করা ঠিক হবে না এই বিবেচনায় কোম্পানী কর্তৃপক্ষ মীরজাফরের প্রস্তাব মেনে
নেয়। ৬ই মে তারিখে মুর্শিদাবাদে অবস্থিত ওয়াটসকে খবর দেওয়া
হলো যে মীরজাফরের প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হয়েছে। ওয়াটসের পক্ষে সরাসরি মীরজাফরের কোন কথা হয়নি যা হয়েছে সবই খোজা পেত্রসের
মাধ্যমে। মীরজাফরের প্রস্তাবের ওপর কোম্পানীর সম্মতির খবর যখন
ওয়াটসের কাছে পৌঁছায় তখন মীরজাফর নবাবের নির্দেশে পলাশী সৈন্য শিবিরে অবস্থান
করছিলেন। ১২ই মে তারিখে খোজা পেত্রস পলাশীতে গিয়ে মীরজাফরকে
কোম্পানীর সম্মতির কথা জানালেন। এবং সাথে সাথে কোম্পানীর
শর্তও তাকে জানানো হলো। এত সব পরেও ক্লাইভের মনে মীরজাফরকে ঘিরে সন্দেহের মেঘ
দানা বেঁধে উঠছিল কারণ মীরজাফর কীভাবে কোথায় ইংরেজদের পক্ষে লড়াইয়ে নামবেন সে
বিষয়ে কোন কিছুই তখনও ঠিক হয় নি। এই বিষয়ে শলা-পরামর্শের জন্য
তিনি কলকাতা প্রত্যাগত স্ক্রাফটনকে পলাশীতে মীরজাফরের শিবিরে পাঠালেন কিন্তু
স্ক্রাফটনের পক্ষে নবাবের চরদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মীরজাফরের সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হলো না। ৩০শে মে মীরজাফর নবাবের হুকুমে মুর্শিদাবাদ ফিরলেন। স্ক্রাফটন ক্লাইভের পরামর্শ মত তার সাথে ষড়যন্ত্রে কার্য পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা
করতে যেয়ে দেখলেন দরবারের যে অবস্থা তাতে মীরজাফরের সাথে কোনভাবেই কথা বলা সম্ভব
নয়। ২রা জুন ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম রাজা রায় দুর্লভ পলাশী
থেকে মুর্শিদাবাদ ফিরলেন। মীর জাফরের সাথে আলাপে জানতে
পারলেন ফিরিঙ্গীরা আড়াই কোটি টাকা চায়। তাতে রায় দুর্লভ আপত্তি
উত্থাপন করেন। তিনি প্রস্তাব করেন নবাবকে হত্যার পর যে টাকা হাতে
আসবে তার অর্ধেক ইংরেজরা পাবে। ৩রা জুন রায় দুর্লভের আপত্তির কথা জানতে পেরে ওয়াটস
চন্দন নগরে অবস্থানরত ক্লাইভকে জানান, “মীর জাফরের সাথে আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।...সে রায় দুর্লভের হাতের পুতুল। ... তারা আমাদের কোন কাজে আসবে না। আমরা জয়ী হলে তারা তার ফল ভোগ করবে আর নইলে আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই এমন
ভাব দেখিয়ে আগের মতই থাকবে। তাদের মতো a set of shuffling,
lying, spineless wretches -দের সাথে কোন চুক্তি বা সম্পর্কের মধ্যে যাওয়া উচিৎ নয়। একথার পরও ওয়াটস মীরজাফরের কাছে আধাআধি পস্তাবে রাজী
হয়ে দূত পাঠালেন। ৫ই জুন মীরজাফরের সাথে সাক্ষাৎকারে স্ক্র্যাফটনের ব্যর্থতার
কথা এবং তদবধি মীরজাফরের সাথে প্রস্তাবিত চুক্তিনামায় তিনি এখনও সই করেননি জানতে
পেরে ক্লাইভ হতাশাগ্রসত হয়ে ওয়াটসকে লিখলেন -“আপনি আগাগোড়া ঠকে গেছেন। চুক্তির কাগজপত্রগুলো ফেরৎ নেওয়া ছাড়া আপনার আর কোন কাজ নেই। আমি ঐ সব রাস্কেলদের সাথে কোন অভিযানে বের হবোনা।” ঐ দিনই অর্থাৎ ৫ই জুন তারিখেই রায় দুর্লভের পরামর্শ মতো মীরজাফর ইংরেজদের প্রণীত
চুক্তিনামায় ইংরেজদের আরোপিত শর্তেই সই করলেন। ইতোমধ্যে মীরজাফর সেনাপতির পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। দুটি ভিন্ন পত্রে এই দুটি খবর জানিয়ে ঐ দিনই ওয়াটস ক্লাইভের কাছে দূত পাঠালেন। ৬ই জুন ক্লাইভ ওয়াটসকে লিখলেন- আপনি লিখেছেন চুক্তির
শর্তে ওরা রাজী হয়েছে আর সেগুলো আপনি আমাকে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কে কি আমার সঙ্গে যোগ দেবে? কেমনভাবে? কবে? কে কে? জেনে রাখুন এই ক’টি বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি
এক পাও এগুবোনা। স্ক্রাফটন তো একটা Plan of Operations ঠিক করার জন্য মীর জাফরের সাথে মন্ত্রণা করতে গিয়ে মুর্শিদাবাদে ফেঁসে
গিয়েছিলেন। আবার আপনি লিখেছেন মীরজাফর
বকশি (সেনা পতির ) পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন আমার ধারণা নবাব কিছু একটা
জেনে ফেলেছেন, আর রায় দুর্লভ আমাদের এবং মীরজাফরের সাথে
বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ” ক্লাইভ তাকে নির্দেশ দিলেন শুধু চুক্তি সই করলেই হবে না মীরজাফরকে কোরান
স্পর্শ করে কসম করাতে হবে। ক্লাইভের কড়া চিঠি পেয়ে ওয়াটস প্রমাদ গুনলেন। তখন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের কার্যক্রম নিয়ে মীরজাফর আলীর সাথে তার সরাসরি
কোন আলোচনা হয়নি। চারদিকে নবাবের চর ঘুরছে। ওয়াটসের সাথে মীরজাফরের সাক্ষাৎ হয়েছে এই খবর পেলে নবাব দ’জনেরই গর্দান নেবেন। তবুও ওয়াটস মরিয়া হয়ে প্রাণ হাতে করে সন্ধ্যায় খোজা পেত্রসের পরামর্শ মতো
জেনানাদের পর্দাঘেরা পালকিতে চেপে একেবারে মীর জাফরের গৃহের অন্দর মহলে গিয়ে
ঢুকলেন। মীরজাফর মাথায় কোরান শরীফ নিয়ে পুত্র মীরণের মাথায় হাত
রেখে বললেন চুক্তিপত্রে ও অন্যান্য কাগজে যা আছে তিনি তা অক্ষরে
অক্ষরে পালন করবেন। প্লান অব অপারেশনস বিষয়ে আলোচনা হলেও কোন নির্র্দিষ্ট
পরিকল্পনায় উপনীত হওয়া গেল না। এ ব্যাপারে মীরজাফর ওয়াটসকে
জানালেন, যুদ্ধ শুরু হলে তিনি যদি নবাবী ফৌজের সম্মুখভাগে থাকেন তাহলে ঢাক পিটিয়ে
পতাকা তুলে ক্লাইভের বাহিনীর ডান দিকে গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেবেন। আর যদি তিনি নবাবের ডানে বাঁয়ে বা পিছনে থাকেন তাহলে তিনি যুদ্ধের ময়দানে
ত্বরিৎ গতিতে নবাবকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করবেন, চেষ্টা সফল হলে তিনি সাদা পতাকা তুলে
দেবেন। ৭ই জুন মীরজাফরের বিশ্বস্ত সেনানী মীর্জা আমীর বেগ
মীরজাফর স্বাক্ষরিত চুক্তি পত্র নিয়ে কলকাতায় ক্লাইভের কাছে রওনা হলেন। ইতোমধ্যে জগৎশেঠের প্ররোচনায় ইয়ার লতিফ খান মীরজাফরের সাথে হাত
মেলালেন। ফলে মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে বাহ্যত আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী
থাকলো না। ইতোমধ্যে নবাব তার মাতামহের ভগ্নীপতি মীরজাফর আলীকে
সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে তার জায়গায় খাজা আব্দুল হাদি খানকে বসিয়েছেন। মীরজাফর সেনাপতির পদ হারিয়ে দরবারে আসা ত্যাগ করে নিজের বাসগৃহে অবস্থান
করতে লাগলেন এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলতে লাগলেন। তিনি তার জমাদারদের একত্রিত করে সিদ্ধান্ত নিলেন, হয় ময়দানে বেরিয়ে গিয়ে ইংরেজদের আসার অপেক্ষায় ছাউনি
ফেলবেন না হয় এখনি নবাব ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করবেন। এই সব পরিস্থিতির আলোকে ৯ই জুন দ্রুতগামী হরকরা মারফৎ ওয়াটস ক্লাইভকে জানালেন- Whether
we interfere or not it appears affairs will be decided in few days by the
destruction of one of the parties (i.e. either the
Nabab of Mir Jafar). ওয়াটস এখবর জানানোর সাথে সাথে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে
পালাবার জন্য ক্লাইভের কাছে অনুমতি চাইলেন। ১১ই জুন ক্লাইভ ওয়াটসকে পালানোর অনুমতি দিলেন। ১২ই জুন ক্লাইভ চন্দন নগর থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা
শুরু করলেন। ১৩ই জুন নবাবের কাছে ক্লাইভ কড়া ভাষায় চিঠি লিখলেন
নবাব শর্ত ভঙ্গ করায় তিনি কাশিমবাজার আসছেন। তিনি ঐ চিঠিতে নবাবকে দোষারোপ করলেন যে, তাদের কাছে খবর আছে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার
জন্য ফরাসী সেনাপতি মঁসিয়ে ল’কে মাসে দশ হাজার টাকা করে দিচ্ছেন। এই চিঠি ও ইংরেজদের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর পেয়ে নবাব প্রমাদ গুনলেন। তিনি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ও সুহৃদদের সাথে পরামর্শ করে বুঝলেন
মীরজাফরের সাথে বিবাদ মিটিয়ে তাকে দলে টানা ছাড়া এই বিপদ মোকাবেলা করা যাবে না। নবাবের অনুরোধে মীর জাফর ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে রাজী হলেন। ১৯শে জুন নবাবের অসহায়ত্বের কথা এবং যুদ্ধের ময়দানে
তার সম্ভাব্য অবস্থান জানিয়ে ক্লাইভ শিবিরে অবস্থানরত মীর্জা আমীর বেগের কাছে
চিঠি লিখলেন। ঐ দিনই অর্থাৎ ১৯শে জুন ইংরেজরা কাটোয়া দূর্গ দখল করে নেয়। এখানে ছাউনি ফেলে ক্লাইভ গঙ্গা পার হয়ে পলাশীর দিকে যাবেন কি যাবেন না এই
নিয়ে ইতস্তত করতে লাগলেন। কারণ চুক্তি মতো মীরজাফরের
কাছ থেকে নবাব বাহিনীর খবরাখবর আসার কথা। কিন্তু কোন খবর না পেয়ে
ক্লাইভ মীরজাফরকে চিঠিতে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন-মীরজাফর নিজের দলবল সহ নবাবী ফৌজ
ছেড়ে বেরিয়ে এসে পলাশীতে তার সাথে যোগ না দিলে তিনি কাটোয়া ছেড়ে এক পাও অগ্রসর
হবেন না। ঐ ১৯শে জুনই তিনি কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির কাছে
মীরজাফরের সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকতায় তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন-
“মীরজাফর সাহায্য না করলে কি করবো সে সম্বন্ধে খোলাখলিভাবে আপনাদের মতামত পাবার ইচ্ছা পোষণ করি।” ২০শে জুন ক্লাইভ বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামানকে চিঠি
লিখলেন- তিনি যদি নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাকে তিন শ’ ঘোড়সোয়ার দিয়ে সাহায্য করেন তা হলে তিনি তার জমিদারির
ওপর কোন আমিল (রাজস্ব আদায়ের তত্ত্বাবধায়ক) বসাবেন না । কিন্তু পাঠান রাজা আসাদুজ্জামান তার প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না। ২১শে জুন সিদ্ধান্তহীনতায় আক্রান্ত ক্লাইভ সিলেক্ট
কমিটির কাছে পরামর্শ চাইলেন মীরজাফর যখন প্রতারণা করছে বলে মনে হচ্ছে তাহলে
নবাবের সাথে কোন সম্মানজনক শর্তে সন্ধি করার অনুমতি তারা দেবেন কিনা। ২১শে জুনেই দিবাবসানে হতাশাগ্রস্ত ক্লাইভ মীরজাফরের চিঠি পেলেন। তাতে ক্লাইভকে তার উদ্যমহীনতার জন্য রীতি মতো ভর্ৎসনা করা হয়েছে- ‘‘আপনি এখন
পর্যন্ত খালি চিঠি চালা চালিই করে যাচ্ছেন কাজের কাজ কিছুই করেননি। এখন আপনার আরামের সময় নয়। আপনি যখন কাছে আসবেন তখন আমি
আপনার সাথে যোগ দেবো।” ঐ দিনই অর্থাৎ ২১শে জুন গভীর রাতে ক্লাইভ তার বাহিনী নিয়ে গঙ্গা পার
হয়ে রাত ১টায় (ক্লাইভের ভাষায়- by one in the morning.) পলাশীর আম্রকাননে ছাউনি ফেললেন। সেখান থেকে মীর আমীর বেগের মারফৎ তিনি মীরজাফরকে তার চরম পত্র দিলেন- আমার যা করার তা
করেছি, আর কিছু করার নেই। আপনি যদি দাউদপুর পর্যন্ত আসেন তাহলে আমি পলাশী ছেড়ে
এগিয়ে আপনার সাথে মোলাকাত করবো, কিন্তু আপনি যদি তাও না করেন তবে আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি নবাবের সাথে বিবাদ মিটিয়ে
ফেলবো। ২২শে জুন ভোর না হতেই নবাবের ঘোড় সওয়ার, পদাতিক ও গোলন্দাজ সৈন্যরা
পায়ে পায়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে আসতো লাগলো। ২৩শে জুন ভোর ছটার সময় নবাবের সৈন্যদল দাউদপুর শিবির
থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ঐ দিনই পলাশীতে যুদ্ধ নামের ঐতিহাসিক ও কলঙ্কময় নাটিকাটি অভিনীত হলো। যার ফলাফল বিশ্ববাসীর জানা। এই ধারাবাহিক বর্ণনাটি পাঠ করলে বেশ ভালো ভাবে বোঝা
যায় নবাব সিরাজের অভিষেকের মুহুর্ত্যে সূচিত ষড়যন্ত্র
পলাশীর যুদ্ধের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত নানা রূপে নানা
মাত্রায় চালু ছিল এবং ষড়যন্ত্রকারীদের কারো পক্ষেই করণীয় স্থির করার জন্য
আনুষ্ঠানিকভাবে কোন পূর্ব নির্ধারিত স্থানে বৈঠকে বসা সম্ভব হয়নি। আর ষড়যন্ত্রকারীদের শেষ বৈঠক বলতেও কোন কিছুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নেই। আসলে এই আমঝুপির এই স্থানটির সে সময়কার অবস্থাটি তাহলে
কি ছিল? এ ব্যাপারে সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তার গ্রন্থে উলেখ করেছেন, কাজলা নদীর খরস্রোত-বিধৌত
বাঘ-শুকর থাকার মতো বিশাল জঙ্গলে আবৃত ছিল বলে অত্র এলাকার প্রাচীন
ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে জানা যায়। মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানীর
অধীনে আমঝুপি নীলকুঠিতে ইংরেজ আমলের সর্বশেষ নায়েব ছিলেন মোঃ দবিরউদ্দিন। তিনি আমঝুপি নীল কুঠি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নীলকুঠিয়ালদের আমলে এখানে
নীলকুঠি স্থাপিত হয়। তার পূর্বে এ ্অঞ্চলে তেমন কোন জনপদ ছিল না বললেই চলে। রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়ন সম্পর্কে তিনি
বলেছেন, এটা অবাস্তব এবং অত্যন্ত দুঃখজনক কল্পকাহিনী। পলাশীর ষড়যনেত্রর সাথে আমঝুপির নীলকুঠিকে সংশিষ্ট করে
তৎকালীন সময়ের কতিপয় কর্তাভজা ইতিহাস রচনার নামে যে বালখিল্য প্রদর্শন করেছেন
তা ক্ষমার অযোগ্য এক ইতিহাস বিকৃতি ও অত্যন্ত দুঃখজনক অপপ্রচার। এ বিষয়ে সকল বিভ্রান্তির অবসান হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে দেশ বিদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবেত্তাদের আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়েজন। মেহেরপুর মহাকুমা ও গাংনী থানার প্রতিষ্ঠা:
পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো মেহেরপুরও ইংরেজ শাসনে
চলে যায়। ১৭৮৭ সালে নদীয়া জেলা গঠিত হয়। মেহেরপুর নদীয়ার অন্যতম মহকুমা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৫৪ সালে। সে সময় মেহেরপুরের থানা ছিল পাঁচটি: করিমপুর, গাংনী, চাপড়া, তেহট্ট ও মেহেরপুর। তবে মেহেরপুর ও গাংনী থানা হিসেবে প্রতিষ্টা লাভ করে তারও পূর্বে, ১৭৯৯ সালের দিকে। ১৮৯২ সাল থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত পার্শ্বর্তী চুয়াডাঙ্গা মহকুমা মেহেরপুর
মহাকুমার সাথে সংযুক্ত ছিল। জাতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মেহেরপুর: ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধোত্তর কালে ঔপনিবেশক অপশাসন ও
অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং জাতীয় স্বাধীনতা ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারে যে সকল আন্দোলন-সংগ্রাম
পরিচালিত হয় তার সকল ক্ষেত্রেই মেহেরপুরের গৌরবোজ্জ্বল অংশিদারিত্ব মেহেরপুরের
আধুনিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে সে ইতিহাসের অনেক পৃষ্ঠাই
বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে। নীলবিদ্রোহ: উনবিংশ শতকের শেষার্ধে মেহেরপুরসহ এই অঞ্চলে নীলকরদের
অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে তা সুসংগঠিত হয়ে ক্রমান্বয়ে বিদ্রোহে রূপ নেয়। মেহেরপুরে নীলের চাষ শুরু হয় সম্ভবত: ১৭৯৬ সালে। ১৮১৫ থেকে ১৮২০ খৃস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালে মেহেরপুরের আমঝুপি, ভাটপাড়া, নিশ্চিন্তপুর, রতনপুর, কাথুলি, গোয়ালগ্রাম, সাহেবনগর, রশিকপুর, ষোলটাকা, বেতবাড়িয়া, বৃত্তিবাড়িয়া প্রভৃতি স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। নবাব আলীবর্দ্দি খাঁর বদান্যতায় প্রতিষ্ঠিত মেহেরপুর জমিদারির জমিদার গোয়ালা
চৌধুরী বর্গী হামলায় নিহত হলে এই জমিদারি নাটোরের রাণী ভবানীর কর্তৃত্বে আসে । রাণী ভবানীর হাত থেকে উক্ত জমিদারি কাশিমবাজারের জমিদার হরিনাথ কাছে
হস্তান্তরিত হয়। হরিনাথের পুত্র কৃষ্ণনাথ মেহেরপুর ডিহি জেম্স হিল
নামক কুখ্যাত ইংরেজ নীল কুঠিয়ালের কাছে পত্তনী দেন। নদীয়া কাহিনী অনুসারে ১২৪৮ বঙ্গাব্দে (১৮৪১ খৃ.) জেম্স হিল মেহেরপুর পত্তনী
নিলেও মথুর বাবু (মথুরানাথ মুখোপাধ্যায়)-এর সাথে তাঁর বিবাদের কারণে ১২৬০
বঙ্গাব্দ (১৮৫৩ খৃ.)-এর পূর্ব পর্যন্ত জেমস হিলের পক্ষে মেহেরপুরের দখল নেওয়া
সম্ভব হয়নি। জেম্স হিলের কুঠি ছিল নিশ্চিন্তপুরে। তার অত্যাচারের কাহিনী কিংবদন্তী হয়ে আছে। অন্যান্য নীলকরদের মধ্যে কেনী, ফারগুসন, ক্রাফোর্ড, স্টিভেন্স, সিম্সন, জেম, শেব্লী, ওয়াট্স ও হেমিল্টন তাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের জন্য
মেহেরপুরের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন। নীলকুঠিয়ালদের অত্যাচারের
মাত্রা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেলে নীলচাষীরা তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ
শুরু করেন। বিক্ষুব্ধ কৃষকরা বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি আক্রমন করেন। তাদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারে কোন প্রতিকার না পেয়ে কৃষকরা সরকারি খাজনা
দেওয়া বন্ধ করে দেয়। মেহেরপুর অঞ্চলে নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকবিদ্রোহের
নেতৃত্ব দেন রতনপুর-নাটুদহের জমিদার নফরপাল চৌধুরী। বিভিন্ন স্থানের কৃষকদের বিদ্রোহ এবং বিশেষত: কৃষকরা খাজনা বন্ধ করে দেওয়ায়
সরকার নীলচাষীদের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য কমিটি গঠন করে। কমিটির সুপারিশ মতে ১৮৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষার্ধে সরকার নীলচাষ নিয়ন্ত্রণ ও কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য একটি
বিজ্ঞপ্তি জারি করে। অবশেষে ১৮৯৫ সালের শেষের দিকে এ অঞ্চল থেকে নীলচাষ
বিলুপ্ত হয়ে যায়। ওয়াহাবি আন্দোলন: তৎকালীন নদীয়া জেলার ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম ক্ষেত্র
ছিল মেহেরপুর। মেহেরপুরে ওয়াহাবি আন্দোলনের নের্তৃত্ব দেন আফির
উদ্দিন বিশ্বাস ও আজিমউদ্দিন মোল্লা। তাঁদের বাড়ি কুষ্টিয়ার
কুমারখালী হলেও তাঁদের সাংগঠনিক কর্মক্ষেত্র ছিল মেহেরপুর । তাঁরা বৃটিশ সরকারের কোপানলে পড়ে কাবুল ও কান্দাহারে হিজরত করেন। ফারায়েজি আন্দোলন: ইসলামকে বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করে মুসলমান
হিসেবে নিজেদের মর্যাদার আসনে আসীন করার জন্য প্রধানত আলেমগণের দ্বারা সূচিত
ফারায়েজি আন্দোলনে মেহেরপুরের অংশগ্রহণ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এ আন্দোলনে মেহেরপুরের অবদান বিষয়ে কোন লিখিত ইতিহাস না থাকলেও মেহেরপুর
জেলার বিশেষতঃ গাংনী উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে যথা, সাহেবনগর,কাজীপুর, হাঁড়াভাঙ্গা, নওপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে ফারায়েজি আন্দোলনের মূলনীতির
অনুসারীদের সক্রিয় উপস্থিতি থেকে অনুমান করা যায় এই সব এলাকায় ফারায়েজি আন্দোলন
ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। খেলাফত আন্দোলনঃ রাজনৈতিক ভাবে মুসলমানদের হৃত গৌরব তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য ইসলামের
গৌরবময় ঐতিহ্যচেতনাপুষ্ট মুসলমান চিন্তানায়কদের সমন্বয়ে
গড়ে ওঠা খেলাফত আন্দোলনে মেহেরপুরের অংশগ্রহণ ছিল। গাংনী উপজেলার গাঁড়াডোব নিবাসী বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুন্শী জমিরউদ্দিন
বিদ্যাবিনোদ এ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্বদেশী
আন্দোলন: বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের একটি
উজ্জ্বল ও গৌরবময় অধ্যায় স্বদেশী আন্দোলন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে
মেহেরপুর জেলার অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন । সৈয়দ আমিনুল ইসলাম গাংনী উপজেলার গাংনী বাজার নিবাসী প্রবীণ ব্যক্তি জনাব
সবদেল মণ্ডলের বরাত দিয়ে মেহেরপুরের ইতিহাস গ্রন্থে স্বদেশী
আন্দোলনের একটি চিত্র তুলে ধরেছেনঃ গাংনী থানায় স্বদেশী আন্দোলনের একটি চির স্মরণীয়
কাহিনী আজো সবার মুখে মুখে রয়েছে। ধানখোলা গ্রামের আলফাজ মিয়া স্বদেশী আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ কর্মী
ছেলেন। ১৯৩০ সালের দিকে গাংনী বাজারে বিলাত থেকে আমদানীকৃত
ধুতী কাপড় একজন ক্রেতার কাছে থেকে কেড়ে নিয়ে তাতে প্রকাশ্যে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিলাতী ধুতী আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে এই খবর গাংনী থানায় পৌঁছিয়ে যায় দ্রুত। তখন থানার দারোগা ছিলেন নওজেস আহমেদ। দারোগা বিলাতী কাপড়ে আগুন
দেওয়ার অভিযোগে আলফাজ মিয়াকে গ্রেফতার করতে গেলে আলফাজ মিয়া দারোগাকে মারপিট
করেন। কিন্তু পরে তিনি গ্রেফতার হন। নদীয়া জেলার সদর কৃষ্ণনগরের আদালতে বিচারে আলফাজ মিয়ার এক মাসের জেল হয়। তবে ব্যারিস্টার আজিজুল হক আলফাজ মিয়ার পক্ষে ওকালতি করে তার দণ্ড মওকুফ
করিয়েছিলেন। গাংনীতে স্বদেশী আন্দোলনে আলফাজ মিয়ার সহকর্মী ছিলেন পিয়ার সর্দার, মানিক বিশ্বাস প্রমুখ। গাংনীর তৎকালীন মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুধাংশু বাগচি, গাঁড়াডোব নিবাসী শিবকালী
লাহিড়ী, মনি সান্যাল, বিজেন বোস, বিভূতি বাবু প্রমুখ স্বদেশী
আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলন: পাকিস্তান আন্দোলনে মেহেরপুরের অবদান অবিস্মরণীয় । মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নদীয়া জেলার সম্পূর্ণ অংশ যাতে পাকিস্তানে পড়ে
এমনকি কলিকাতা নগরও যাতে মুসলমানদের হাতছাড়া না হয় এই মনস্তাত্বিক প্রেষণা থেকে
মেহেরপুরের আপামর জনসাধারণ পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। এ আন্দোলনে গাংনী থানার অবদান বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। গাংনী থানার মহম্মদপুর নিবাসী অ্যাডভোকেট আব্দুল হান্নান ১৯৩০ সালে মুসলিম
লীগে যোগ দিয়ে স্বীয় যোগ্যতাবলে বিশিষ্ট নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পাকিস্তান আন্দোলনের গাংনী থানার সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে উলেখযোগ্য ছিলেন, গাংনীর আব্দুল ওয়াহেদ, মহসীন আলী, হোসেন আলী, ধানখোলার আলতাফ হোসেন
বিশ্বাস, চিৎলার শামসুল ইসলাম, ধর্মচাকীর হাজী এলাহী বক্স, চৌগাছার হাজী রিয়াজউদ্দিন, বাওটের লিয়াকত আলী বিশ্বাস, ছাতিয়ানের ইয়াছিন বিশ্বাস, চেংগাড়ার হাজী ফাকের আলী প্রমুখ। মেহেরপুরের ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস: ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর একটি প্রাচীন প্রশাসনিক
একক তথা মহকুমা হিসেবে মেহেরপুরের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ১৯৪৮ সালের প্রথমার্ধে মেহেরপুর মহকুমাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। মেহেরপুর সদর থানাকে নব গঠিত কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমার অন্তর্ভূক্ত
করা হয়। অপর থানা গাংনীকে কুষ্টিয়া সদর মহকুমার অন্তর্ভূক্ত
করা হয়। কিছুদিন পরে গাংনীকেও চুয়াডাঙ্গা মহকুমার অন্তর্ভূক্ত
করা হয়। মেহেরপুর থেকে মহকুমা সদর উঠে যাওয়ায় জনগণ
দূর্ভোগের শিকার হতে থাকেন এবং মেহেরপুরে মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠার দাবীতে অচিরেই
ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, অ্যাডভোকেট আবুল হায়াত
,আব্দুর রহিম, কিয়ামউদ্দিন খান, নলীনাক্ষ্য ভট্টাচার্য, সতিনাথ গোপ্তি, বিনয় মোক্তার, সাখাওয়াৎ মুনসী, ইদ্রিস আলী প্রমুখ। ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জাকির হোসন কুষ্টিয়াতে সফরে এলে
নেতৃস্থানীয় উক্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে মেহেরপুরবাসীর দূর্ভোগ এবং মেহেরপুরে মহকুমা পুন:প্রতিষ্ঠার দাবীর কথা
জানান। জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে মেহেরপুর পুনরায় মহকুমা
হিসেবে তার মর্যাদা ফিরে পায়। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে
মেহেরপুরঃ ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের
অব্যবহতি পর থেকে ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচন ভিত্তিক ব্যাপক গণজাগরণের কাল
পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে মেহেরপুর জেলার অধিবাসীদের
সক্রিয় অংশগ্রহণ মেহেরপুরের ইতিহাসকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে। জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রভূমি তথা রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক দুরের প্রত্যন্ত
একটি অঞ্চল হলেও এই অঞ্চলের সচেতন জনতা বিশেষকরে প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাকামী
রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের আন্তরিক ও নিরলস কর্মকাণ্ডের
ফলে তৎকালীন জাতীয় আন্দোলন ও কর্মসূচীসমুহে আপামর জনসাধারণের
ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তবে যথাযোগ্য সংরক্ষণের অভাবে এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের
একটি বিরাট অংশ বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল সূত্র ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে
মেহেরপুরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্যাপকভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী
ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনীর গুলি বর্ষণ ও রফিক, সফিউর, বরকত, সালাম সহ আরো অনেক ছাত্র-জনতার শাহাদৎ বরণের ঘটনায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মেহেরপুরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২৪শে ফেব্রুয়ারী মেহেরপুরের তৎকালীন ছাত্র নেতা-কর্মী মুন্সী
সাখাওয়াৎ হোসেন, কাউছার আলী চানা, শান্তি, বংকা ঘোষ, নারায়ণ চক্রবর্তী, সতীনাথ ঘোষ প্রমুখের নেতৃত্বে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ
সমাবেশ করা হয়। তাদের নেতৃত্বে তীব্র পিকেটিং-এর মাধ্যমে ঐ দিন
মেহেরপুরে সাধারণ ধর্মঘটও পালিত হয়। ১৯৫৪ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী
পালনের দায়ে মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের বেশ কিছু ছাত্রকে স্কুল থেকে Rusticate করা হয়। পরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে তা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট গঠিত হলে মেহেরপুরের জনতা তার
প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করেন। এই নির্বাচনে মেহেরপুরের
জনগণের ভোটে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী মৌলবী আব্দুল হান্নান আইন পরিষদ সদস্য
নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে মেহেরপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে মেহেরপুরের
রাজনীতি নবধারা সূচিত হয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করলে
মেহেরপুরের ছাত্র-জনতা তার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানায়। ৬ দফা দাবীকে সামনে নিয়ে মেহেরপুরে ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। এই সময় মেহেরপুর থেকে মুসলিম লীগ প্রায় বিলুপ্ত হতে থাকে। ১৯৬৯ সালের স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনে মেহেরপুরে জোয়ার সৃষ্টি হয়। ছাত্র-জনতার বিশাল বিশাল মিছিল সভা সমাবেশে মেহেরপুর মহকুমার সদর ও গাংনী
থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল কাঁপিয়ে তুলেছিল। আন্দোলন চলার এক পর্যায়ে
মেহেরপুর শহরে ছাত্র-জনতার একটি মিছিলের প্রতি আনছার বাহিনীর এক সদস্য অশ্লীল
মন্তব্য করলে ছাত্র-জনতার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে, এক পর্যায়ে গুলি বর্ষণের ঘটনা
ঘটে। এই ঘটনায় সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করলে ছাত্র নেতা আবু
বক্কর মিয়া, নজরুল ইসলাম ও একরামুল হক কালু গ্রেফতার হন। ছাত্র নেতা শহীদুল্লাহ, নাসিরুদ্দিন, ওমরুল হুদা ও আব্দুস সামাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা
হয়। আব্দুস সামাদ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠান হয়। একই ঘটনায় ন্যাপের সভাপতি আহমদ আলী এবং অ্যাডভোকেট আসগর আলীকেও গ্রেফতার করা
হয়। একুশ দিন কারাভোগের পর ১৯৬৯ সালের ২৪শে মার্চ আইয়ুব খানের পদত্যাগের পরপরই
তারা মুক্তি লাভ করেন। আবু বক্কর মিয়া, নজরুল ইসলাম ও একরামুল হক কালুকে সামরিক আদালতে
সংক্ষিপ্ত বিচারে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এক বছর কারাভোগের পর তারা মুক্তি লাভ করলে মেহেরপুরের জনতা তাদের প্রিয়
নেতাদের বিপূর সংবর্ধনা দিয়ে সম্মান জানায়। ঊনষত্তরের গণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত ১৯৭০
সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে মেহেরপুরে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ আসনে মোট প্রার্থী ছিলেন চারজন, আওয়ামী লীগের,মোঃ সহিউদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লীগের
অ্যাডভোকেট খালেদুজ্জামান, ন্যাপ(ভাসানী)র অ্যাডভোকেট আসগর আলী এবং জামায়াতে
ইসলামীর অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, আওয়ামী লীগের নুরুল হক, ন্যাপ(ভাসানী)র আহমদ আলী এবং জামায়াতে ইসলামীর
শামসুদ্দিন। মহকুমার দুই থানার প্রতিটি গ্রামে আওয়ামী লীগের
প্রার্থী ও নৌকা মার্কার প্রতি এক অভূতপূর্ব ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের আসনে সহিউদ্দিন এবং প্রাদেশিক পরিষদের আসনে
নুরুল হক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা
সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে
মেহেরপুর: [এই অধ্যায়ের সমস্ত তথ্য সৈয়দ আমিনুল ইসলামের
মেহেরপুরের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে নেওয়া] বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মেহেরপুরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে
গেছে। পূর্ব বাংলার এক প্রান্তে অবস্থিত ছোট্ট এক মহকুমার
প্রত্যন্ত একটি গ্রাম বৈদ্যনাথতলা ইতিহাসের এক মহান ঘটনার জন্মলগ্নের ধাত্রী
মর্যাদা লাভ করেছে। ইতিহাসের কী মহান খেয়ালিপনা, ২১৪ বছর আগে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দুরের পলাশীর
আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে সূর্য অস্ত গিয়েছিল তারই যেন মহিমান্বিত
অভ্যুদয় ঘটল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আরেক আম্রকাননে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মাহেন্দ্রক্ষণের ধারক আমাদের প্রিয় মেহেরপুরের মাটি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসক
গোষ্ঠি বিশেষত: পাকিস্তানী সামরিক আমলা, বণিক গোষ্ঠি এবং তাদের পদলেহী রাজনৈতিক গোষ্ঠি ক্ষমতা
হারানোর আশঙ্কায় নির্বাচনের ফলাফলকে অকার্যকর করার জন্য যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়
বাঙালী মাত্রই তার পূর্বাপর কাহিনী জানেন। সারা দেশের মানুষের মত
মেহেরপুরের মানুষও নির্বাচনে বাঙালী তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জয় লাভে অধীর
আগ্রহে দিন গুনছিলেন কবে তাদের প্রিয় নেতা মজিবর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
মেহেরপুর মহকুমার সাধারন মানুষ এই নামেই ডাকতেন, তুলনামূলক অগ্রসর চেতনার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের
কাছে তার পরিচয় ছিল শেখ সাহেব। হয়তো এখনও আছে।) পাকিস্তানের “রাজা” হবে। কিন্তু তাদের সেই
কায়মনোবাক্যের প্রার্থনাকে আসুরিক শক্তি দিয়ে দমন করার জন্য পাকিস্তানীরা
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যে ইতিহাস সচেতন নাগরিকদের অজানা নয়। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্রের বেড়া ডিঙিয়ে বাঙালী তার অভিষ্ট লক্ষ্যের ঠিকানা পেয়ে
যায় বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন ও পরিশেষে স্বাধীনতার
ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বাঙালী জাতি কার্যত তার
আজন্ম লালিত স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ঘোষণা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” এবং “তোমাদের যা কিছু আছে তাই
নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে” বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের এই ভাষণকে তারা আক্ষরিক
অর্থেই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে গ্রহণ করে এবং যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত
হতে থাকে। মেহেরপুরের দুটি থানার প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত তাদের
প্রিয় নেতা মজিবরের নির্দেশ অনুসারে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে
থাকে। এ প্রেক্ষাপটে ২৫শে মার্চ রাজধানী ঢাকায় পাকবাহিনীর
আক্রমণ এবং গণহত্যার সংবাদ ঐ রাতেই ঢাকা টেলিফোন এক্সচেন্জ থেকে কুষ্টিয়ার
এক্সচেনজে পৌঁছায়। ২৫শে মার্চ রাতেই কুষ্টিয়া শহরে ২৫০ জন পাকিস্তানী
সৈন্য আকস্মিকভাবে প্রবেশ করে এবং কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে শিবির স্থাপন করে। তারা শহরে প্রবেশ করেই কারফিউ জারী, ধর পাকড়, অত্যাচার নির্যাতন ও মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন
শুরু করে। এ সংবাদ মেহেরপুর সহ কুষ্টিয়ার তিনটি মহকুমায় ছড়িয়ে
পড়লে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের
বহ্নি শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়। ঢাকায় পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ
এবং কুষ্টিয়া শহরে পাকহানাদার বাহিনীর প্রবেশের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে তা মেহেরপুর
টেলিফোন এক্সচেনজে পাঠান হয়। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য গাংনীর
নুরুল হক সঙ্গে সঙ্গে এ খবর মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে
জানিয়ে দেন। সংবাদ পাওয়া মাত্র এসডিও সাহেব, জাতীয় পরিষদ সদস্য মেহেরপুর শহরের সহিউদ্দিন ও আওয়ামী
লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মেহেরপুর থানার ওয়্যারলেস স্টেশনে উপস্থিত হন । তাদের নির্দেশে ওয়্যারলেস অপারেটর আব্দুস সামাদ ঢাকার সাথে যোগাযোগের জন্য
আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ঢাকার রাজার বাগ পুলিশ লাইন থেকে Movement Start কেবল এই বার্তাটুকু গ্রহণ করতে সক্ষম হন এর পর পরই
ঢাকার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অগ্নিস্ফলিঙ্গের মত এই সংবাদ রাতারাতি মেহেরপুর শহর ও
গাংনী বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মেহেরপুরের মানুষ তো আগে থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল, তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে
শুরু করে। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের প্রশাসনিক নেতৃত্বে শুরু
হয় সম্ভাব্য পাকিস্তানী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের বাস্তব প্রস্তুতি। মহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে মেহেরপুর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী ইসমাইল হোসেন ও
মেহেরপুরের সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর গাংনী বাজারে যেয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগ
নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২৫শে মার্চ রাতেই মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের
খলিশাকুণ্ডির কাঠের সেতু নষ্ট করে দেন। ২৬শে মার্চ সারাদিন ব্যাপি আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর
সদস্যদের সংগঠিত করে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। মেহেরপুর জেলখানায় আটক কয়েদী ও হাজতীদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। মহকুমা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে জনগণকে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও আক্রমণের
কলা-কৌশল শেখান শুরু হয়। মহকুমা প্রশাসক স্বয়ং পেট্রোল বোমা তৈরি ও নিক্ষেপ
করার প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। ২৬শে মার্চ সকালের দিকে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ভারতে দুটি চিঠি পাঠান। একটি চিঠি নদীয়ার জেলা শাসকের কাছে। অপরটি পাঠান হয় মেহেরপুর
সীমান্তের বিপরীতে অবস্থিত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সি. ও. লেফটেন্যান্ট
কর্নেল চক্রবর্তীর কাছে। চিঠি দুটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত
। একটিতে লেখা ছিল, Indian Brethren help us. অন্যটিতে ছিল, Help us with arms. দু’টি চিঠিতেই মেহেরপুরের
মহকুমা শাসক হিসাবে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী স্বাক্ষর
করেন। একটি চিঠির বাহক ছিলেন ইদ্রিস
আলী ও শাহাবাজ উদ্দিন লিজ্জু। তারা চিঠিটি মেহেরপুর সদর
থানার অন্তর্গত দারিয়াপুরের আলীজান মাস্টার ও ডাঃ শামসূল হুদার সহায়তায় নাটনা
সীমান্ত ফাঁড়ির মাধ্যমে ভারতে পৌঁছিয়ে দেন। অপর চিঠিটি বুড়িপোতা ইউনিয়নের বাড়ীবাঁকা গ্রামের নবীছউদ্দিন আহমদের পুত্র
ইদ্রিস আলী খোকাই শেখের পুত্র মজিবর রহমান ও পাতান শেখের পুত্র মহাম্মদ আলী ভারতীয়
সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর নাটনা ক্যাম্পে পৌঁছে দেবার জন্য গেলে সেখান থেকে তাদের
তিনজনকে লালবাজার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পত্রবাহকদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ২৯শে মার্চ পর্যন্ত
তাদের হেফাজতে রেখে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রাপ্ত
কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন যাদব মেহেরপুর থেকে প্রাপ্ত চিঠির বিষয়ে তার উর্ধতন
কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে
মেহেরপুরের মহকুমা শাসকের পত্র প্রেরণের বিষয়টি ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বের
সাথে প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে মেহেরপুরের মহকুমা
প্রশাসক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ২৯শে মার্চ মেহেরপুরের সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়ি বেতাই ক্যাম্পে
নদীয়ার জেলা শাসক ও বিএসএফ-এর অধিনায়ক কর্নেল চক্রবর্তীর সাথে মেহেরপুরের মহকুমা
প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে সম্ভাব্য পাকিস্তানী
আক্রমনের ফলে উদ্ভূত শরণার্থী প্রবাহ নির্বিঘ্ন ও সহজতর করার জন্য সীমান্ত
উন্মুক্ত করে দেবার ব্যাপারে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে মেহেরপুরের প্রশাসনিক
ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দ্রুত ও নিশ্চিত যোগাযোগ স্থাপনের স্বার্থে
মেহেরপুরের মহকুমা শাসকের সীলমোহর ও স্বাক্ষরযুক্ত পরিচয়
পত্রকে পাসপোর্ট হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধ: ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী দেশের
সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে ইপিআর-এ চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ উইং-এর হাবিলদার মেজর মজিবর
রহমান উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াই ২৬শে মার্চ ভোরের দিকে চুয়াডাঙ্গা উইং
হেডকোয়ার্টারের সকল অবাঙালী সদস্যকে আটক করেন। এই দিনেই চুয়াডাঙ্গা ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এই অঞ্চলে
সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর অস্থায়ী প্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২৫শে মার্চ রাতে আগত পাক হানাদার পাকবাহিনী ২৭শে মার্চ
কুষ্টিয়া শহর পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেয়। কুষ্টিয়াকে পাকবাহিনীর দখলে
রেখে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা থেকে নিরাপদে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং যুদ্ধ
পরিচালনা করা ভাবে সম্ভব নয় এই কৌশল গত দিক বিবেচনায় এনে অবিলম্বে কুষ্টিয়া
শহরকে হানাদার মুক্ত করার জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার জনতাই সর্ব প্রথম
পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে এবং সংক্ষিপ্ত প্রস্তুতিতে বলতে গেলে ঢাল-সড়কি
নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধে স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর নিখাদ
দেশপ্রেমই ছিল জনতার প্রধান হাতিয়ার । ২৫শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর কুষ্টিয়া অনুপ্রবেশের
পরপরই কুষ্টিয়ার তিন মহকুমার রাজনৈতিক ও সামরিক-বেসামরিক নেতৃবৃন্দ কুষ্টিয়াকে
হানাদার বাহিনীর দখল মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করা শুরু করেন। পরিকল্পনা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৯শে মার্চ ভোর ৪টায় পাক হানাদার
বাহিনীর শিবির জেলা স্কুল আক্রমণ করা হবে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে মেহেরপুর অংশের প্রতিষ্ঠানিক
কাঠামোটি ছিল মহকুমা শাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে, তাকে সহায়তা করেন আওয়ামী লীগ
নেতা সহিউদ্দিন, জালাল উদ্দিন, গোলাম রহমান, নুরুল হক, ইদ্রিস আলী; ছাত্র নেতা সহিদুল ইসলাম, আব্দুর রশীদ, চাঁদ আলী, মহিউদ্দিন, সাহবাজ উদ্দিন লিজ্জু প্রমুখ। মহকুমা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রথম কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজারের মুছাদের বাড়ীতে মহকুমার সকল বন্দুক মালিকদের
সহযোগিতায় বন্দুক বাহিনীর কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। গাংনী থানা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গাংনী বাজারে একটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করে
মেহেরপুরের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের ব্যাবস্থা করেন। আনসার, মুজাহিদ এবং দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ যুদ্ধ যাবার জন্য প্রস্তুত সাধারণ মানুষকে
সংগঠিত করে মেহেরপুর ও গাংনীতে রাতদিন সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। মেহেরপুর শহরের নিউমার্কেটে প্রশিক্ষণার্থীদের খাদ্য সরবরাহের জন্য অস্থায়ী
ক্যাম্প খোলা হয়। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের ফ্রন্টের একটি নামকরণও করা
হয়- ‘সাউথ ওয়েস্টার্ন কমান্ড’ অর্থাৎ ‘দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন’। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এই কমান্ডের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কমন্ডার নিযুক্ত হন। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে মেজর ওসমানের কমান্ডের অধীনে ৭০০ বাঙালী ইপিআর সদস্য
ছাড়াও আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ মুক্তিপাগল স্বেচ্ছাসেবকগণ যোগ দেন। ২৯শে মার্চ ভোর ৪টায় পাকবাহিনীর ওপর হামলার দিন-ক্ষণ
নির্ধারিত করা হলেও কুষ্টিযা সদর মহকুমার দৌলতপুর থানার ফিলিপনগর সীমান্ত এলাকা
থেকে সুবেদার মোজাফফরের নেতৃত্বে ইপিআর-এর একটি কোম্পানির কনভয় কুষ্টিয়ার অদুরে
দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে যথা সময়ে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিতে ব্যর্থ হলে আক্রমণের সময়
২৪ ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। পরিবর্তিত সময়-সূচী অনুসারে ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায় জেলা
স্কুলে অবস্থিত পাকবাহিনীর অবস্থানে বাঙালী প্রতিরোধ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত নরহত্যার আদিম নেশায় উন্মত্ত একটি বাহিনীর
বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে বাঙালী যোদ্ধাদের দৃঢ় দেশপ্রেম, নিরঙ্কুশ জনসমর্থন আর যুদ্ধজয়ের অদম্য বাসনা ছিল
প্রধান অস্ত্র। ইপিআর,পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের
পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র, যুবক, সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সাধারণ বন্দুক, টু টু বোর রাইফেল, এয়ার গান, ঢাল-সড়কি, লাঠি-ফালা, দা-কুড়াল, যার যা ছিল তাই নিয়ে অংশ
গ্রহণ করেন। তাদের পিছনে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক
বাহিনী ও আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপনা
ও সাহস জোগাতে “জয় বাংলা” ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। অকস্মাৎ গোলাগুলির শব্দ ও গগন বিদারী জয় বাংলা ধ্বনিতে পাক
হানাদার বাহিনী হতভম্ব হয়ে যায়। তারা কোন প্রকার পাল্টা
আক্রমণ তো দুরের কথা আত্মরক্ষার উপযুক্ত কৌশলও উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়। আক্রমণের ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই কুষ্টিয়ার অধিকাংশ এলাকা ও স্থাপনাসমুহ
মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এই যুদ্ধে অধিকাংশ পাকসেনা
নিহত হয়। দিন শেষে জেলা স্কুলের পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছাড়া সমগ্র
কুষ্টিয়া শহর মুক্তি বাহিনী শত্রু মুক্ত করে। হানাদার বাহিনী কার্যত তাদের শিবিরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সারা দিনের যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত প্রাণহানি ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার ঘটনায় এবং কোন
প্রকার ত্বরিৎ সাহায্যের কোন আশা না থাকায় সর্বোপরি জনগণের কাছ থেকে
ন্যুনতম সহানুভূতি না পেয়ে পাকবাহিনীর মনোবল ও যুদ্ধ করার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে এই যুদ্ধে মৃত্যুর হাত থেকে পালানো ছাড়া আর কোন উত্তম বিকল্প নেই। ৩০শে মার্চ রাত ৮টার দিকে তিনটা জিপে করে পাকবাহিনীর একদল পর্যুদস্ত সৈন্য
ঝিনাইদহের দিকে পালানোর চেষ্টা করলে শৈলকুপার কাছে তারা জনতার প্রতিরোধের মুখে
পড়ে প্রাণ হারায়। ৩১শে মার্চ ভোর বেলা মুক্তিবাহিনী পুনরায় পাকবাহিনীর
ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের কিছু সময়ের মধ্যেই পাকবাহিনীর ক্যাম্প
মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। পাকবাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। তাদের অধিকাংশ সৈনিক যুদ্ধে প্রাণ হারায়, জীবিতরা পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে গ্রামবাসী ও
প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে তারাও নিহত হয়। পাক বাহিনীর ব্যবহৃত
অত্যাধুনিক বিপুল অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। যুদ্ধ-জয়ী বীর মুক্তিবাহিনী ও জনতার বিজয়োলাসে কুষ্টিয়ার আকাশ বাতাস
আনন্দমুখরিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে প্রথম যুদ্ধে বাঙালী
মুক্তি যোদ্ধাদের এই বিজয় একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই যুদ্ধে জনতার অংশগ্রহণ ছিল আরেকটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে জেলার তিনটি মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে এবং
পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ, শৈলকুপা ও হরিণাকুণ্ডু থেকে শত শত মুক্তিকামী সংগ্রামী
ছাত্র-জনতা ট্রাকে ও বাসে করে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরী খাবার, ভাত, রুটি, ডাব, চিড়া, মুড়ি, গুড়, ছাতু ইত্যাদি নিয়ে এসেছিলেন। তারা যুদ্ধ চলাবস্থায় প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে যেভাবে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে
মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেছিলেন সেই আত্ম-নিবেদনের অক্ষয় স্মৃতি কোন দিন
ম্লান হবে না। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে মেহেরপুর থেকে ৫০ জন
মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে মেহেরপুরের ২জন
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাঁরা হলেন: (১) খন্দকার আব্দুর রশীদ, পিতা: ডাঃ আব্দুর রহমান খন্দকার, গ্রাম-বামন পাড়া, মেহেরপুর। (২) মোঃ ফজলুর রহমান, পিতা: নছির উদ্দিন, মেহেরপুর শহর, মেহেরপুর। ঐ যুদ্ধে মেহেরপুরের আহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: (১) রায়হান উদ্দিন, পিতা: আব্দুল লতিফ, গ্রাম: রতনপুর, মেহেরপুর। (২) গোলাম রহমান, পিতা: নুর মোহাম্মদ, গ্রাম: মনোহরপুর, মেহেরপুর। (৩) আব্দুল মজিদ (পাতান), পিতা: দুধ মলিক শাহ, মেহেরপুর বড় বাজার। (৪) মোঃ পাতান আলী, পিতা: রতন আলী, মুখার্জি পাড়া, মেহেরপু। (৫) আবদুর রশিদ, পিতা: ইছাহাক বিশ্বাস, গ্রাম: চক শ্যাম নগর, মেহেরপুর। (৬) রবিন, গ্রাম: ভবেরপাড়া, মেহেরপুর। ১লা এপ্রিল সমগ্র কুষ্টিয়া জেলা পাকিস্তানী শাসন মুক্ত
হয়ে যায়। এই সময় থেকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও মাগুড়া অঞ্চলে স্বাধীন
বাংলাদেশের প্রথম প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হয়। অফিস-আদালতে এবং আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসমুহে স্বাধীণ
বাংলাদেশের পতাকা বিরামহীনভাবে উড়তে থাকে। সম্মুখ যুদ্ধে পর্যুদস্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী
১লা এপ্রিল কুষ্টিয়ায় উপর্যুপরি বিমান আক্রমণ করে। এই বিমান হামলায় কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজ, জেলা স্কুল ও কয়েকটি বাড়িঘর গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ৩রা এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চালায়। বিমান হামলার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিকামী জনতার মধ্যে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করা
এবং কুষ্টিয়ার যুদ্ধের গ্লানিকর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। কিন্তু কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার এই বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিকামী
জনতা আরও কঠিন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ৩১শে মার্চ একদিকে যখন কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে
অন্যদিকে ঐ দিনই ভারতের চেংখালী সীমান্ত ফাঁড়িতে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক
তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী, মেজর আবূ ওসমান এবং তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার
আমিরুল ইসলাম ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সম্ভাব্য ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতার জন্য
এক বৈঠকে মিলিত হন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর দ’জন কর্মকর্তা গোলক
মজুমদার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী এই বৈঠকে ভারতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকের সিদ্ধান্তানুসারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিছু ত্রাণ সামগ্রী ও হালকা
অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে
বিজয় লাভের পর ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মেহেরপুর মহকুমাকে সম্ভাব্য
পাকিস্তানী হামলা থেকে রক্ষার জন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ইপিআর-এর জোয়ানদের সার্বিক তত্বাধানে মেহেরপুর আনসার ব্যারাকে কুষ্টিয়া
প্রতিরোধ যুদ্ধে লব্ধ পাকিস্তানী অস্ত্র দিয়ে বেসামরিক যুবক ও ছাত্রদের সামরিক
প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বে ১লা এপ্রিল থেকেই মেহরপুর
সহ কুষ্টিয়া জেলার তিনটি মহকুমা এবং ঝিনাইদহ ও মাগুড়া মহকুমা অঞ্চলে রণপ্রস্তুতি
অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সুশৃংখল ও যুদ্ধোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে
সামরিক প্রশিক্ষণকালেই সামরিক চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। কুষ্টিয়ায় অবস্থিত বাঙালী বাহিনীতে মেজর আবু ওসমান ছাড়া আর মাত্র এক জন
কমিশন্ড অফিসার ছিলেন। তাই জরুরী ভিত্তিতে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাকসক
তৌফিক-ই-ইলাহী, ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন ও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক সফিক
উল্লাহকে সরাসরি সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে কমিশন দেওয়া হয়। তাদের এই কমিশনিং আদেশ জারি করেন মেজর আবু ওসমান। এই আদেশটিতে বলা হয়: “On behalf of the Bangladesh High
Command, I hereby award commission to the following persons directly in the
rank of Captain to meet operational requirements: (a)
Mr.Towfiq Elahi Chowdhury. (b)
Mr.Mahbubuddin Ahmed. (c)
Mr. Safiqullah. এই তিনজন অফিসারই ১৯৭১ সালের শেষ দিন পর্যন্ত এই
সেক্টরে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। কমিশন প্রদানের পর পরই ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন কে ঝিনাইদহ অঞ্চলের সার্বিক
প্রতিরোধের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী
চৌধুরী কে মেহেরপুরের সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন সফিক উল্লাহ মেজর ওসমানের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে তার দায়িত্ব
পালন করতে থাকেন। স্বাধীনতা
ঘোষণাকারী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটিকে কোন
প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোন আনুষ্ঠানিক সরকারী
সিদ্ধান্ত না নিলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা
ও সম্পদ বিনাশকে প্রতিবেশী দেশের একটি জনগোষ্ঠীর মানবিক বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করে
স্বাভাবিক মানবিক দায় বোধ থেকে সীমান্ত
সংলগ্ন এলাকার সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আত্মরক্ষার জন্য নিতান্ত
প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী সাহায্য প্রদান করে। ভারতীয় সামরিক সাহায্য ও অন্যান্য উপকরণ ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধূরীর সার্বিক তত্বাবধানে
সড়ক পথে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত চেংখালী চেকপোস্টের মাধ্যমে মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গায়
প্রেরণ করা হয়। ১০ই এপ্রিলের পর থেকে তা বেতাই সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে
মেহেরপুরে পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব
মূহুর্ত্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটি
থেকে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে বিতাড়িত করার লক্ষ্য ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যাওয়া
মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার
ঘোষণাকে যথার্থ হিসেবে বিশ্বসভায় প্রতিপন্ন করার জন্য
একটি সরকার গঠনের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। এই ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের
সদস্যগণ ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করেন। প্রবাসী সরকারের রাজধানী হিসেবে চুয়াডাঙ্গাকে নির্বাচন করা হয়। এই সময় কুষ্টিয়া জেলার তিনটি মহকুমা এবং পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ ও মাগুড়া
মহকুমার সমন্বয়ে গঠিত মুক্তাঞ্চলের প্রশাসনিক সদর দপ্তর ছিল চুয়াডাঙ্গা। চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের সংবাদ সারা বিশ্বের
সংবাদ মাধ্যমগুলোর সংবাদে দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া জেলার অন্যান্য অঞ্চল সহ চুয়াডাঙ্গা তাৎক্ষণিকভাবেই পাকিস্তানী বিমান হামলার শিকার হয়। ১১ই এপ্রিল কুমারখালীতে, ১৪ই এপ্রিল কুষ্টিয়া শহরে এবং ১৫ ও ১৬ই এপ্রিল
চুয়াডাঙ্গাতে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী বিমান হামলা চালায়। হানাদাররা চুয়াডাঙ্গায় নাপাম বোমা বর্ষণ করে। এতে চুয়াডাঙ্গার কয়েক স্থানে আগুন ধরে যায়। উপর্যুপরি বিমান হামলার ফলে নবগঠিত প্রবাসী সরকারের পক্ষে চুয়াডাঙ্গা
অবস্থান ও কার্যক্রম পরিচালনা করা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয় এবং ১৬ই
এপ্রিল মুক্তাঞ্চলের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরের সন্নিকটে ইছাখালীতে
স্থানান্তর করা হয়। এর একদিন আগে মেজর আবু ওসমানের নির্দেশে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুড়া ও ঝিনাইদহ ব্যাংকে
রক্ষিত নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি মেহেরপুর ট্রেজারিতে
নিয়ে আসা হয়। যুদ্ধকালীন জরুরী প্রয়োজনে এবং নবঘোষিত সরকারের
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় মেটানোর লক্ষ্যেই এই সম্পদ সংগ্রহ করা হয়। সম্পদ সংগ্রহের এই উদ্যোগে চুয়াডাঙ্গার ডাঃ আসহাব উল হক, মেহেরপুরের জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিন, মহকুমা প্রশাসক তথা ক্যাপ্টেন
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি
কার্যকর ভূমিকা রাখেন। এই উদ্যোগে সাড়ে চার কোটি নগদ টাকা এবং ২০ সের স্বর্ণ সংগৃহীত হয়। মেহেরপুর খাদ্য গুদামে রক্ষিত পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্যশস্যও নিরাপদ স্থানে
স্থানান্তর করা হয়। ১৬ই এপ্রিলের মধ্যেই জাতীয় পর্যায়ের সকল নেতৃবৃন্দ
মেহেরপুরে এসে সমবেত হন। নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চলেই নবগঠিত
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হবে। বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর: : মেহেরপুরের ইতিহাসের
গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ঘোষণার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের একটি কার্যকর সরকার
গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে তীব্রভাবে। নবঘোষিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বৈধতা
এবং আন্তর্জাতিক মহলে এই নবসৃষ্ট রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে
জাতীয় পরিষদ সদস্যবৃন্দ ইতোমধ্যেই ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। এই স্বাধীনতার বাস্তবায়ন তথা দখলদার পাক বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে
পরিচালিত যুদ্ধ পরিচালনা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের জন্যও একটি সরকার অপরিহার্য
হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন আঞ্চলিক
ভিত্তিতে একাধিক সামরিক ও বেসামরিক তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে হানাদার
বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধরত বাহিনী সমুহকে একটি একক কমান্ডে
আনার জন্যও একটি সরকার গঠন প্রয়োজন হয়ে পড়ে এমনকি অবিলম্বে একটি সরকার গঠনের
জন্য যুদ্ধরত সামরিক বাহিনীর কমান্ডারগণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি
করতে থাকে। তাদের আশঙ্কা ছিল একটি উপযুক্ত ও বৈধ সরকারের
অনুপস্থিতিতে সেনা বাহিনীর স্বাধীনতাকামী বাঙালী যোদ্ধারা বিশ্বজনমতের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী দস্যু
হিসেবে গণ্য হবে। (উদাহারণ স্বরূপ: On April 4, Major Khaled
Mosharraf took me, Mohammad Ilyas and Altafur Rahman Chowdhury to the Dak
Bunglow at Srimangal and put pressure on us to form a government immediately.
He said that the members of the armed forcess would be branded as bandits by
the outside world if a government was not formed immediately; he added that
they would be compelled to form a government if the Awami League did not form
one. -Dewan Farid Gazi, M.P. Our Liberation War in retrospective, Weekend
Independent, 24 December 1999) . আর এই সরকারের বাস্তব গঠন ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং শপথ
গ্রহণ অনুষ্ঠান যাতে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে হয় এ বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে
বিবেচনা করা হয়। সকল দিক বিবেচনা করে মেহেরপুর শহর থেকে সামান্য দূরে
পাকিস্তানী হামলার আশঙ্কামুক্ত সীমান্তবর্তী যে কোন স্থানকে বেছে নেবার
সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পরপরই মেহেরপুর
সীমান্তবর্তী এলাকায় সীমান্ত সংগ্রাম পরিষদ নামে স্বাধীন
বাংলা প্রত্যাশী একটি সংগঠন গঠিত হয়। মেহেরপুরের বাগোয়ান ইউনিয়নের ভবরপাড়া গ্রামে এই সংগঠনটির তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। সীমান্তবর্তী এই এলাকার জনমত সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিল এটা
কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে পূর্বাহ্নেই অবহিত করা হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান নির্বাচনের সময়
অন্যান্য বিষয়ের সাথে সীমান্তবর্তী এই এলাকাটির এই বিশেষ অবস্থাটিও বিবেচনা করা
হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৫ই এপ্রিল সকালের দিকে ক্যাপ্টেন এম
মনসুর আলী ভবরপাড়া ও বৈদ্যনাথতলা সরজমিন পরিদর্শন করেন। তিনি ভবরপাড়া সীমান্ত সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ঘোষণা দেন যে বৈদ্যনাথতলায় নবগঠিত সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। তার এই ঘোষণার পরপরই এই
এলাকায় সাজসাজ রব পড়ে যায়। ১৬ই এপ্রিল থেকে পুরো এলাকায়
কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। সারাদিন ধরে মঞ্চ তৈরী এবং
আনুষাঙ্গিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়। এই কাজে ভবরপাড়া সীমান্ত
সংগ্রাম পরিষদের কর্মী ও নেতৃবৃন্দ প্রধান ভূমিকা পালন করেন। মঞ্চে নেতৃবৃন্দের আসন তৈরীর জন্য ইপিআর ক্যাম্প থেকে চৌকি সরবরাহ করা হয়। মঞ্চে ওঠার সম্মুখ ভাগে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। তোরণের ওপরে কাপড় ও তুলা দিয়ে ইংরেজিতে Welcome লিখেছিলেন ভবরপাড়া মিশনের সেবিকা ভগিনী ক্যাথরিনা ও
ভগিনী তেরেজিনা। পরের দিন ১৭ই এপ্রিল। মেহেরপুর শহর প্রায় জনশূন্য। চারিদিকে থমথমে ভাব। সন্নিকটে আগত হানাদার বাহিনীর
ভারী অস্ত্রের গর্জন মেহেরপুরের সর্বত্র প্রকম্পিত করে তুলেছে। তখনও পর্যন্ত হানাদাররা মেহেরপুরে প্রবেশ করতে পারেনি। মেহেরপুর মহকুমার বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বিপ্লবী সরকারের
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে এই সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা ভীড় জমাতে থাকেন। কয়েকশ বিদেশী সাংবাদিক বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সমবেত হন। সকাল থেকেই ব্যাপক আয়োজন শুরু হয়। স্থানটিতে কঠোর নিরাপত্তার
ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্যদের মধ্যে স্থানীয় ১২ জন আনসার এই ঐতিহাসিক
ঘটনার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত হন । তারা হলেন, সিরাজউদ্দিন, লিয়াকত আলী, সাহেব আলী, হিন্দ কমান্ডার, হামদিল, হাফিজউদ্দিন, আজিমউদ্দিন শেখ, মহি মণ্ডল, অস্তির মল্লিক, আরশাদ আলী, ইয়াদ আলী কমান্ডার, ও নজরুল ইসলাম। গাঢ় ছায়াবৃত আম্রকাননের এক
পাশে একটি সাধারণ মঞ্চ ও তোরণ। বাঁশের কাবারী দিয়ে অতি
সাধারণ একটি বেষ্টনি তৈরী করা হয়েছে। বেলা তখন ১১টা। দীর্ঘ আলোচনার পর বহু প্রতীক্ষিত সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের সূচনা হলো। অনুষ্ঠান সূচী তৈরী করেছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-
ইলাহী চৌধুরী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, তাজ উদ্দিন আহমদ, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি
ওসমানী ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ মঞ্চে এসে দাঁড়ান। অনুষ্ঠান সূচী অনুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই সময় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল তাকে গার্ড-অব-অনার দেয়। আয়োজিত অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন আনন্দবাস মিয়া মনসুর একাডেমীর
সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ বাকের, পবিত্র বাইবেল পাঠ করেন পিন্টু বিশ্বাস। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন আসাদুল হক, সাহাবুদ্দিন আহমদ সেন্টু, পিন্টু বিশ্বাস ও ঢাকা থেকে আগত কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী। অধ্যাপক ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এই ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠণ ও ঘোষণা
দেওয়া হয়। এর পর পরই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার ঘোষণা ও সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে
মেহেরপুর মহকুমার একটি অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম বৈদ্যনাথতলা স্বাধীন
বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী হিসেবে মুজিবনগর নাম ধারণ
করে এক মহান জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে যায়। মুজিবনগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের এই সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নবঘোষিত প্রজাতন্ত্রের
রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে
উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে
উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাজউদ্দিন আহমদ নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। খোন্দকার মোশতাক আহমদকে আইন, সংসদীয় ও পররাষ্ট্র দপ্তর, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র
দপ্তর এবং ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে অর্থ দপ্তরের
দায়িত্ব দেওয়া হয়। কর্ণেল এম.এ.জি.ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক
নিযুক্ত করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিনের
নেতৃত্বে পূর্বোলিখিত ১২জন আনসার ও অন্যান্যদের সমন্বয়ে
গঠিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড-অব-অনার প্রদর্শন করে। এই সময় মঞ্চে তার ডান পাশে একটু পিছনে সতর্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিলেন
মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী। শপথ গ্রহণের অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নবগঠিত সরকার ও অভ্যাগত অতিথিবৃন্দ
ঐতিহাসিক এই আম্রকানন ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যান। প্রগাঢ় শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত একটি বিশালায়তন আম্রকানন তার আঁচলতলে অনুষ্ঠিত
ইতিহাসের এক মহৎ অধ্যায়ের সজীব চিত্রের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিকে বুকে ধরে
নীরবে তার নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার অস্তিত্বে প্রোথিত মুজিবনগর এক
বিমূর্ত বাস্তবতা হয়ে ব্যাপ্ত হয়ে গেল বাঙালীর সংগ্রামী চেতনা ও কর্মে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলির প্রতিটি ক্ষণে মুজিবনগর হয়ে উঠলো অনিবার্য
উচ্চারণ আর বাঙালীর অবিনাশী আশ্রয়।
১৮ই এপ্রিল। পাক হানাদার বাহিনী এদিন
দুপুরে মেহেরপুর শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সড়কপথে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহরপুর আসর সময়ে আমঝুপিতে আটজন নিরীহ গ্রামবাসীকে
তারা হত্যা করে। আমঝুপি থেকে নিক্ষিপ্ত হানাদারদের মর্টার শেলে
মেহেরপুর টিবি ক্লিনিক ও মৎস বিভাগীয় ভবন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি মর্টার শেল ওয়াপদা রোডে আঘাত হানে, এতে একজন পথচারী নিহত হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করে তারা আতঙ্ক সৃষ্টি করে। হানাদাররা শহরের বিভিন্ন স্থানে লক্ষ্যহীনভাবে গুলি বর্ষণ করে সারা শহরের
ত্রাস সৃষ্টি করে সন্ধ্যার আগেই চুয়াডাঙ্গা ফিরে যায়। ১৯শে এপ্রিল বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ
থেকে ব্যাপক সামরিক প্রশিক্ষণের কর্মসূচী নেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে নবপ্রতিষ্ঠিত রাজধানী মুজিবনগরের অদূরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী
বাহিনীর শিবিরের কাছেই হৃদয়পুর গ্রামে একটি খামারবাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শিবির
খোলা হয়। ২০শে এপ্রিল থেকে পাক হানাদার
বাহিনী মেহেরপুর শহরে থানাকাউন্সিলে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে আরো সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে হানাদাররা মেহেরপুরের ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট, কালাচাঁদপুর, কামদেবপুর ও সীমান্ত এলাকায়
স্থায়ী শিবির স্থাপন করে। মুক্তি যুদ্ধ সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সকল যুদ্ধফ্রন্টকে ১১টি
সেক্টরে ভাগ করা হয়। মেহেরপুর মহকুমা আট নম্বর
সেক্টরের অন্তর্গত হয় । এই সেক্টরের পরিধি ছিল মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুরের অধিকাংশ এবং খুলনা জেলার দৌলতপুর, সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত । আগস্ট মাস পর্যন্ত আট নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরবর্তীতে এই সেক্টরের দায়িত্ব মেজর এম মঞ্জুর পালন করেন। এই সেক্টরের অধীনে সাতটি সাব-সেক্টর ছিল। এর মধ্যে লালবাজার, বেনাপোল ও শিকারপুর সাবসেক্টর থেকে পরিচালিত অভিযান
মেহেরপুর ভিত্তিক ছিল। এই তিনটি সাব-সেক্টরে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন
অ্যাডজুটেন্ট হাসেম আলী খান, ইপিআর সুবেদার মতিন পাটোয়ারী, ইপিআর আবুল কালাম, আব্দুর রউফ, আব্দুল হান্নান, শহীদুল ইসলাম, সৈয়দ সাদেক হোসেন রুমি, কায়েমউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল গাফফার, এস এম আল আমিন, আব্দুল মালেক, সামসুল আসলাম, কাজী মোমেনুল হক, রাশেদুল ইসলাম, গোপালচন্দ্র সাহা, ইউসুফ গনি, আব্দুল ওহাব, আব্দুল হান্নান, আসগর আলী, আবুল কাসেম, মকবুল হোসেন (মুজিব বাহিনী), সামসুল আলম সোনা, তাহাজউদ্দিন, মকলেছুররহমান , মোহাম্মদ আলী ও ফজলুল হক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উলেখযোগ্য ঘটনাবলী যাদবপুর গ্রামে পাকহানাদারদের অগ্নি সংযোগঃ পাক
হানাদারবাহিনী মেহেরপুরে শিবির স্থাপন করেই জনমনে ত্রাস সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ ও
লুটপাট করতে থাকে। তাদের পরিকল্পিত আক্রমণের প্রথম শিকার হয় যাদবপুর
গ্রাম। ৩০শে এপ্রিল হানাদাররা যাদবপুর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামের সমস্ত কাঁচা খড়ের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মেহেরপুরে হানাদারদের দোসরদের নিয়ে শান্তি কমিটি (পিস
কমিটি)গঠনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান
মেহেরপুরের আবালবৃদ্ধবণিতা যখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাহুমুক্তির জন্য কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার
কাছে প্রার্থনা করছে আর যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বান্তঃকরণে সাহায্য সহযোগিতা
করছে তখন একদল কুলাঙ্গার হানাদারদের দালাল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তথাকথিত শান্তি
কমিটি বা পিস কমিটি গঠন করে। ১৯৭১-এর মে মাসের শেষের দিকে
হানাদার বাহিনীর মেহেরপুর শিবিরের প্রধান ক্যাপ্টেন আব্দুল লতিফের তত্ত্বাবধানে
মেহেরপুর মহকুমা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর চেয়ারম্যান হয় দালাল
সাবদার আলী বিশ্বাস আর সেক্রেটারি হয় আব্দুল মতিন । সে একজন উকিল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে ভারত সৃষ্ট
একটা গণ্ডগোল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কুতকারী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং তাদের মতো
দালালদের সংগঠিত করে রাজাকার বাহিনী তৈরী করা যারা মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা
করবে । এই শান্তিকমিটির দালাল আর রাজাকাররা মেহেরপুরের অসংখ্য
নিরীহ নাগরিককে হত্যা করেছে। এরা মেহেরপুর মহকুমা
প্রশাসকের দপ্তরের আমতলায় ট্রেজারির কাছে এবং মেহেরপুর কলেজের পিছনে দুটি
বধ্যভূমি সৃষ্টি করেছিল। নভেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত রাজাকারদের সহায়তায় হানাদাররা শত শত বাঙালীকে হত্যা
করে ঐ দুই বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। মেহেরপুর হানাদারমুক্ত হবার পরপরই মেহেরপুর কলেজের পিছন থেকে শহীদ বাঙালীদের
পবিত্র দেহাবশেষ তথা কংকাল উদ্ধার করে গোরস্থানের কাছেই একস্থানে সমাধিস্থ করা
হয়। মেহেরপুরে তথাকথিত অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়ঃ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এহিয়া খান পাকবাহিনীর নির্যাতন
ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়টিকে একটি সাময়িক ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে
বিশ্বজনমতকে ধোঁকা দেবার জন্য ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেশে
প্রত্যাবর্তনের জন্য আহ্বান জানান । তার এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে
দালালদের সহায়তায় ঢাকঢোল পিটিয়ে মেহেরপুরে একটি অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়। কিন্তু এই অভ্যর্থনা শিবির শূন্যই পড়ে থাকে। মুক্তিবাহিনীর গাংনী থানা আক্রমণঃ ১২ই জুন মুক্তিবাহিনী গাংনী থানা অবরোধ করে প্রচণ্ড
আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তিনজন পুলিশ নিহত হয়। থানার দারোগা আব্দুস সাত্তারসহ তিনজন পুলিশকে আহত অবস্থায় ধৃত করে
মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। দারোগা সাত্তার কুষ্টিয়ার
প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে পাক হানাদাররা মুক্তিবাহিনীর শিবির হিসেবে পরিচিত
সীমান্তবর্তী ধর্মদহ গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। তেরাইল ব্রীজ ধ্বংসঃ ২৬শে জুন মুক্তিবাহিনীর একটি দল গাংনী-কুষ্টিয়া সড়কের
তেরাইল ব্রীজটি বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেন। এই অভিযানে কুষ্টিয়া থানার হরিপুরের সামসূল হাদি, শামসূল বারী ও চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়ার হাফিজুর রহমান জোয়ার্দ্দার
অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের
শাহাদত বরণঃ জুলাই ’৭১, আব্দুল জব্বারঃ নিজ বাড়িতে হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধা
আব্দুল জব্বার পিতা- মাহতাব উদ্দিন বিশ্বাস, গ্রাম- আমঝুপি থানা- মেহেরপুর, শহীদ হন। তিনি মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য
ছিলেন। নাসির উদ্দিনঃ ইছাখালী সীমান্তে পাকহানাদারদের সাথে সম্মুখ সমরে
নাসির উদ্দিন, পিতা- আয়েন উদ্দিন জোয়ার্দ্দার, গ্রাম- মদনাডাঙ্গা , থানা- মেহেরপুর শহীদ হন। তিনি আনসার সদস্য ছিলেন। রফিকুল ইসলামঃ মেহেরপুর শহরে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করতে এসে
হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম পিতা- মনসুর আহমেদ গ্রাম-
মেহেরপুর থানা- মেহেরপুর শহীদ হন। তিনি আনসার সদস্য ছিলেন। জালাল হোসেনঃ নিজ গ্রামে হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন মুক্তিযোদ্ধা
জালাল হোসেন পিতা- কালু মণ্ডল গ্রাম- রামদাসপুর থানা- মেহেরপুর শহীদ হন। তিনি আনসার সদস্য ছিলেন। আব্দুল মান্নানঃ কাথুলি সীমান্তে হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে
শহীদ হন আব্দুল মান্নান পিতা- হেকমত আলী গ্রাম- কুতুবপুর থানা-মেহেরপুর। তিনি আনসার সদস্য ছিলেন। হারেজ উদ্দিনঃ নিজ বাড়িতে অবস্থান কালে হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে
মুক্তিযোদ্ধা হারেজ উদ্দিন পিতা- তুষ্ট মণ্ডল গ্রাম-চৌগাছা থানা- গাংনী, শহীদ হন। আব্দুস সাত্তারঃ খুলনার টাউন শ্রীপুরে হানাদারদের সাথে সম্মুখ সমরে
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার পিতা- জাফর মণ্ডল গ্রাম- পিরতলা থানা- গাংনী, শহীদ হন। তিনিও আনসারের সদস্য ছিলেন। দালাল নিজাম উদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতা ও তিন
মুক্তিযোদ্ধার শাহাদাত বরণঃ সাহেবনগর গ্রামের নিজাম উদ্দিন হানাদারদের দালাল হিসেবে কাজ করতো । সে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার ভাণ করে তাদের গোপন তথ্য হানাদারদের সরবরাহ
করতো। জুলাই মাসের এক বর্ষণসিক্ত দুপুরে নিজামের পরামর্শ মতো
হানাদারদের শিবিরে আক্রমণ পরিচালনার জন্য ৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের
শিবিরের কাছাকাছি একটি ঘরে অবস্থান নেন। বিশ্বাসঘাতক নিজাম তাদের ঘরে
আটকিয়ে রেখে হানাদারদের শিবিরে খবর দেয় । হানাদাররা ৮ মুক্তিযোদ্ধাকে
ঘিরে ফেলে । সম্মুখ সমরে তিন জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দু’জন হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। এই ঘটনার প্রতিফল হিসেবে
দালাল নিজাম উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আব্দুল জলিলঃ গাংনী থানার হিজলবাড়িয়ার কাছে হানাদারদের হাতে ধরা
পড়ে শহীদ হন আব্দুল জলিল পিতা- খবির উদ্দিন, গ্রাম- চৌগাছা থানা-গাংনী । আগস্ট’৭১ আবুল হোসেনঃ অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধা আবূল হোসেন পিতা- পাঁচু শেখ ওরফে
সত্য শেখ গ্রাম- মেহেরপুর, থানা-মেহেরপুর, মেহেরপুরে হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। হানাদাররা তাকে মোটরগাড়ির পিছনে বেঁধে প্রকাশ্য দিবালোকে মেহেরপুর শহরের
রাস্তা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়। হানাদারদের অমানবিক নির্যাতনে
তিনি শহীদ হন। তিনি আনসারের সদস্য ছিলেন। আবুল কাসেম শেখঃ বুড়িপোতা সীমান্তে হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে
শহীদ হন আবুল কাসেম শেখ পিতা- মোঃ ফজল শেখ গ্রাম- গোবিন্দপুর থানা- মেহেরপুর । তিনি আনসারের সদস্য ছিলেন। আয়াতুল্লাহ মল্লিকঃ মুজিবনগরে হানাদারদের সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন
আয়াতুল্লাহ মল্লিক পিতা- অধর মল্লিক গ্রাম- আনন্দবাস, থানা- মেহেরপুর। তিনিও আনসারের সদস্য ছিলেন। সিরাজুল ইসলামঃ সাতক্ষীরা মহকুমার কলারোয়া থানায় হানাদারদের সাথে
সম্মুখ যুদ্ধে মোঃ সিরাজুল ইসলাম পিতা- রব্বানি মণ্ডল গ্রম- মোনাখালী থানা-
মেহেরপুর শহীদ হন। আটজন মুক্তিসেনার শাহাদাত বরণঃ ৫ই আগস্ট মেহেরপুরের ভৈরব নদের তীরবর্তী রশিকপুর
ঘাটের দক্ষিণ দিকের অংশে হানাদারদের সাথে মুক্তিসেনাদের সম্মুখ সমর হয়। এই যুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের ৮জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন । তাঁরা হলেন, হাসান, তারেক, কেয়ামদ্দিন, রওশন, খোকন, কাসেম, রবিউল ও আফাজউদ্দিন। যুদ্ধস্থল থেকে প্রায় তিন কিলমিটার দূরে চুয়াডাঙ্গা
মহকুমার দামুড়হুদা থানার জগন্নাথপুর গ্রামের মাঠে দেশমাতৃকার এই আটজন বীর
সন্তানকে একটি কবরে একত্রে দাফন করা হয়েছে। তাঁদের সমাধিতে একটি স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর ’৭১ আফসার আলীঃ ৭ই সেপ্টেম্বর মেহেরপুর থানার বাগোয়ানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে
অস্ত্রসহ ধরা পড়ে হানাদারদের নির্যাতনে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী
পিতা- দেলবর মণ্ডল গ্রাম- পিরোজপুর, থানা- মেহেরপুর। রবিউল হক ও আরশেদ আলীঃ ২১শে সেপ্টেম্বর মেহেরপুর থানার সোনাপুর গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে
সম্মুখ সমরে বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হক পিতা- শামসুদ্দিন গ্রাম- মল্লিকপাড়া
থানা-চুয়াডাঙ্গা এবং আরশেদ আলী পিতা- লুতফর রহমান গ্রাম- আনন্দবাস, থানা- মেহেরপুর শহীদ হন। অক্টোবর ’৭১ খয়ের উদ্দিনঃ কুষ্টিয়া মহকুমার দৌলতপুর থানার সীমান্ত এলাকায়
হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা খয়েরউদ্দিন পিতা- ইংরাজ
মোল্লা, গ্রাম-পিরোজপুর থানা-মেহেরপুর। আমানুল ইসলাম গাজীঃ মেহেরপুর থানার কুতুবপুর গ্রামে পাক হানাদারদের হাতে
ধরা পড়ে শহীদ হন দেশ মাতৃকার বীর সন্তান আমানুল ইসলাম গাজী পিতা- ইংরাজ মোল্লা
গ্রাম- মল্লিকপাড়া থানা- মেহেরপুর। ৬ বীর মুক্তিযোদ্ধার শাহাদাত বরণঃ গোলাবারুদ নিয়ে আলমডাঙ্গা যাবার সময় গাংনী থানার
জোড়পুকুর ও তার আশেপাশে এলাকায় পাক হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন আলমডাঙ্গা
থানার ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা: (১) নজরুল ইসলাম (২) আবু তালেব (৩) আব্দুল গনি
(৪) আক্কাস আলী (৫) আকবর আলী ও (৬) বারেকউদ্দিন। নভেম্বর ৭১ নাজিমউদ্দিনঃ ২২শে নভেম্বর মেহেরপুর থানার বাড়াদি ফার্মের কাছে হানাদারদের হাতে
ধরা পড়ে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিমউদ্দিন পিতা- মহিম মীর গ্রাম-বাড়াদি, থানা- মেহেরপুর। খয়রুদ্দিনঃ ২৫শে নভেম্বর গাংনী থানার মোহাম্মদপুরে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনে শহীদ হন বীর
মুক্তিযোদ্ধা খয়রুদ্দিন পিতা- নছর শেখ গ্রাম- আমঝুপি থানা- মেহেরপুর। ------------------------- জেনারেল নিয়াজির মেহেরপুর সফরঃ পাকহানাদারদের সর্দার তথা পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের
অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি ৯ই সেপ্টেম্বর মেহেরপুর শহরে এক সফরে আসে। এই সফরকালে সে মানসিক ও শারীরিকভাবে পর্যদস্ত তার দস্যুবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা
করার জন্য তাদের সাথে এক সভায় মিলিত হয়। মেহেরপুরে উপ-নির্বাচনের প্রহসনঃ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় সারা দেশের মত
মেহেরপুরেও জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ আসন শূন্য হয়ে যায়। অক্টোবর মাসে এই শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন হয়। এই উপ-নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের আসনে অ্যাডভোকেট মতিন এবং প্রাদেশিক পরিষদ
আসনে অ্যাডভোকেট খালেদ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। মেহেরপুর শহরে মুক্তিবাহিনীর মর্টার আক্রমণঃ ১২ই নভেম্বর বিকেলের দিকে মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহরের অভ্যন্তরে
প্রচণ্ড মর্টার আক্রমণ শুরু করে। এতে মেহেরপুরবাসীদের মনে যুগপৎ উল্লাস ও আতঙ্কের উদ্রেক হয়। এই আক্রমণে হানাদারদের কয়েকজন
মারাত্মকভাবে আহত হয়। এতে দূর্ভাগ্যবশত: একটি শিশু নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর মর্টার আক্রমণে পাকহানাদার ও তার দোসরদের মনে তীব্র ভীতির
সঞ্চার হয়। মেহেরপুরে মুক্তিবাহিনীর চুড়ান্ত আক্রমণঃ নভেম্বর মাসের প্রথম থেকেই মেহেরপুর মহকুমার সর্বত্র
মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় প্রায় প্রতিদিনই মুক্তিবাহিনীর বীর সন্তানেরা পাকহানাদারদের ওপর তাদের
অবস্থান থেকে ভারী অস্ত্রের আক্রমণ চালাতে থাকেন সাথে গাংনী ও মেহেরপুর থানার
বিভিন্ন স্থানে তাদের গেরিলা অভিযান অব্যাহত রাখেন। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই মুক্তিবাহিনীর একদল অকুতভয় সৈনিক
মেহেরপু-চুয়াডাঙ্গা সড়কের গুরুত্বপূর্ণ দীনদত্ত সেতুটি মাইনের সাহায্যে আংশিক
ক্ষতিগ্রস্ত করেন। হানাদার বাহিনী এসময় কালাচাঁদপুর থেকে ভৈরব নদের তীর
ঘেঁষে বামুনপাড়া পর্যন্ত পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে থাকে। হানাদাররা মেহেরপুর শহরের পূর্বদিকের পুরো এলাকা জুড়ে মাটির নীচে গর্ত খনন
করে তার মধ্যে আশ্রয় নেয়। এই পরিখা ও গর্ত খনন কাজে রাজাকাররা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জোর করে শ্রমিকদের
ধরে আনে। হানাদাররা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ভয়ে দিন রাতের বেশীর
ভাগ সময়ই পরিখার মধ্যে অবস্থান নিয়ে থাকে। ১০ই নভেম্বর
মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে মেহেরপুর শহর অবরোধ করে
রাখেন ফলে হানাদাররা কার্যত: মেহেরপুর শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ২৫শে নভেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহরের ওপর তাদের আক্রমণের মাত্রা তীব্র করে তোলে। তারা অব্যাহতভাবে হানাদারদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। এতে সাধারণ মানুষের মনে বাংলাদেশের মুক্তি ও পাকিস্তানীদের পরাজয়ের ব্যাপারে
প্রবল আশাবাদের সঞ্চার হয়। অপরদিকে পাকহানাদারবাহিনী ও
তাদের দোসর রাজাকারদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তারা সম্ভাব্য পরজয়ের কথা
ভেবে তাদের তল্পি-তল্পা গুটাতে থাকে। এদিন সকাল থেকেই মুক্তিবাহিনী
চারদিক থেকে মেহেরপুর শহরের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। দূর্ভাগ্যবশতঃ একটি গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের রিকশা চালক আইনাল
মিয়ার বাড়িতে এসে পড়লে গোলার আঘাতে তার স্ত্রী হাওয়া বিবি (৩৮) সাথে সাথে মৃত্যু
বরণ করেন। মেহেরপুর শহরে মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের সাথে সাথে
গাংনী থানাতেও তাদের আক্রমণ জোরদার করা হয়। গাংনী থানার মুক্তিবাহিনীর সদস্যের সদর দপ্তর হিসেবে পরিগণিত গোপালনগর থেকে
গাংনীতে অবস্থিত হানাদারদের শিবিরের ওপর ক্রমাগত আঘাত হানা হয়। গাংনী থানার ভাটপাড়াতে অবস্থিত হানাদাররাও ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পিছু হটতে
বাধ্য হয়। তারা ভাটপাড়া থেকে পালানোর সময় ভাটপাড়া-কাথুলি সড়কের
গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি ধ্বংস করে দিয়ে যায়। নভেম্বর মাসেই মেহেরপুরে হানাদারদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় এবং মেহেরপুর মহকুমার
বেশীর ভাগ এলাকা কার্যত মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ২৮শে ও ২৯শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রবল রূপ ধারণ করে। তাদের আক্রমণে পাকহানাদাররা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কোন রকম বিরতি ছাড়াই মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। ফলে পাকহানাদারদের চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। পলায়ন ছাড়া গত্যন্তর না দেখে হানাদাররা ৩০শে নভেম্বর
গভীর রাত থেকে তারা মেহেরপুর থেকে পালাতে থাকে। তাদের এ পলায়ন পর্ব দুদিন ধরে চলে। পলায়নরত পাকহানাদারদের ওপর
মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে কুলপালায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। এতে বেশকয়েকজন হানাদার নিহত হয়। ১লা ডিসেম্বর পালাতে না পারা হানাদারদের অবশিষ্ট অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের
সম্মুখীন হয়। লাল বাজার সাব-সেক্টর থেকে কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী
দল মেহেরপুর এলাকায় হানাদারদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেন। এদিন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা আসগার আলী পিতা-
গয়জদ্দিন গ্রাম-
আমঝুপি থানা-মেহেরপুর ও নুরুল ইসলাম পিতা- মকসেদ আলী গ্রাম- রাজাপুর থানা- মেহেরপুর শহীদ হন। মেহেরপুরের মুক্তিঃ ৩০শে নভেম্বর গভীর রাতে হানাদারদের মেহেরপুর থেকে পলায়নের মধ্য দিয়ে মেহেরপুরের মুক্তি
প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১লা ডিসেম্বর দিবাবসানের আগেই মেহেরপুর শহর মুক্ত হয়ে যায় । শহরের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। জয় বাংলা শ্লোগানে
শহরের অলি-গলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে । গাংনীর মুক্তিঃ মেহেরপুর থেকে হানাদারবাহিনীর পলায়নের আগেই তারা
তাদের গাংনীর শিবির গুটিয়ে নেয় তবে ভাটপাড়াতে তখনও কিছু হানাদার অবস্থান করছিল। হানাদাররা যখন মেহেরপুর থেকে পলায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই অর্থাৎ ৩০শে নভেম্বর সকালের দিকে গোপালনগর থেকে মুক্তিবাহিনী জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে
সিও অফিসের মাঠের মধ্যে অবস্থিত গাংনীর হানাদারদের শূন্য শিবির লক্ষ্য করে গোলা
নিক্ষেপ করে এবং মুহুর্মুহু ফাঁকা গুলি বর্ষণ করতে থাকে। তাদের এই আক্রমণে ভীত হয়ে গাংনীর রাজাকার, আলবদর ও পিস কমিটির সদস্যরা এদিক সেদিক পালাতে থাকে। ঐদিন বিকাল বেলায় ভাটপাড়া থেকে পলায়নপর একদল পাকিস্তানী সৈন্য গাংনী এলে
পাকিস্তানী দালালরা উল্লসিত হয়, তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তানী সৈন্য সেখানে নতুন করে
ঘাঁটি গাড়বে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই হানাদাররা গাংনী ছেড়ে খলিসাকুণ্ডি হয়ে ঈশ্বরদীর
দিকে পালিয়ে যায়। এর ফলে ঐ দিনই কার্যতঃ গাংনী পাক হানাদারমুক্ত হয়ে যায়। ১লা ডিসেম্বর দিবাগত গভীর রাতে মুক্তিবাহিনী গাংনী থানা ও গাংনী বাজারে অভিযান চালায়। গাংনী থানায় অবস্থিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বিনা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে
আত্মসমর্পণ করে এবং মুক্তিবাহিনীর জয়বাংলা ধ্বনির জবাবে উচ্চস্বরে
জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য
প্রকাশ করে এবং সাথে সাথে সেই রাতেই থানা ভবনে এবং গাংনী বাজারের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২রা ডিসেম্বর ভোর হবার সাথে সাথে গাংনীবাসী স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। নিজেদেরই গ্রামের সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পেয়ে তারা তাদেরকে বুকে
জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করে তাদের বরণ করে নেয়। এই অভিযানে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন, মকবুল হোসেন (মিনাপাড়া, মেহেরপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।), আবুল কাসেম কুরাইশী (গাংনী), আসগার আলী (বাদিয়াপাড়া), মহসীন আলী (বাদিয়াপাড়া), আবুলকাসেম (বাদিয়াপাড়া), কদম আলী (ধানখোলা), মোন্তাজ আলী (গোপালনগর), দোয়াত আলী (গাংনী), মুলুকচাঁদ (চৌগাছা), আমিরুল ইসলাম (মালসাদহ), নবীছদ্দিন (চৌগাছা, শহীদ হারেজের ছোট ভাই) প্রমুখ। মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন প্রশাসনঃ গাংনী ও মেহেরপুর মুক্ত হবার
সাথে সাথে শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী হাটবোয়ালিয়ায় এসে মুক্তিবাহিনীর দপ্তর স্থাপন করেন। ১লা ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত হলেও হানাদারদের পুঁতে রাখা স্থল মাইন অপসারণ করে ৪ দিন পর
৫ই ডিসেম্বর মেহেরপুরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করে । ৫ই ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি
দেওয়ার একদিন পরই ৬ই ডিসেম্বর
ভারত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি
দেয়। এর পর পরই ভারতে অবস্থিত
মেহেরপুরের বাস্তুচ্যূত নাগরিক ও প্রবাসী নেতৃবৃন্দ আনন্দ উল্লাসে মেতে
মেহেরপুরে ফিরে আসতে থাকেন। ৭ই ডিসেম্বর
মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য মোঃ সহিউদ্দিন নবপ্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সার্বিক
দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৮ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে মেহেরপুরের প্রথম মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব
গ্রহণ করেন কমল ভট্টাচার্য । ২ সপ্তাহ পর ২২শে ডিসেম্বর
মাহফুজ সোবহানকে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব
দেওয়া হয়। ক্রমেই জনজীবন স্বাভাবিক ধারায় প্রবাহিত থাকে। পরিশিষ্টঃ মেহেরপুর
যুদ্ধফ্রন্টের গেরিলা কমান্ডারগণঃ মেহেরপুর
থানা - (১) সাদেক হোসেন রুমি, বাংগালপাড়া (২)আব্দুর রউফ, হোটেলবাজার (৩)কাজী মোমিনুল হক বাচ্চু, হোটেলবাজার (৪)বশিরউদ্দিন আহমেদ , টংগী (৫)লুৎফর রহমান লালা, হোটেল বাজার (৬)রাশেদুল হক, গৌরিনগর (৭)সহিদুল ইসলাম, ঝাউবাড়িয়া (৮)গোপাল চন্দ্র সাহা, থানাপাড়া (৯)আব্দুল ওহাব, আমঝুপি (১০) ইউসুফ গনি, কোলা (১১) এস এম আল আমিন, যাদবপুর (১২)আমজাদ হোসেন , আমঝুপি (১৩) খাজা নাজিমউদ্দিন, আমঝুপি (১৪) আলাউদ্দিন, আশরাফপুর (১৫) কাইউম চৌধুরী, গোভীপুর (১৬) রমজান আলী, আমঝুপি (১৭) নজরুল ইসলাম, মেহেরপুর (১৮) আলিমুদ্দিন মণ্ডল, দীঘিরপাড়া (১৯) তৌফিক, আশরাফপুর (২০) রমজান মণ্ডল (২১) ইসমাইল, পিরোজপুর। গাংনী থানাঃ - (১) মখলেছুর রহমান, কুমারীডাঙ্গা (২)আব্দূল হান্নান, হিন্দা (৩)আবুল কাসেম কুরাইশী, গাংনী (৪)আসগার আলী, বাদিয়াপাড়া (৫)আজিজুল হক, হেমায়েতপুর (৬)মঈনদ্দিন মন্টু, বাদিয়াপাড়া (৭)আব্দুস সামাদ, বাওট (৮)আব্দুল ওয়াহেদ, হেমায়েতপুর (৯)তাহাজউদ্দিন, মোহাম্মদপুর (১০) বক্কর আলী করমদি। ------------------------------------------------------------ ॥ ইতি মেহেরপুরের ইতিহাস ॥ পাদটিকাঃ মেহেরপুরের ইতিহাস
বর্ণনায় তথ্যগত ত্রুটির আশঙ্কা স্বীকার করে পাঠকদের কাছে অনুরোধ করছি ত্রুটি নির্দেশ পূর্বক
উপযুক্ত সূত্রসহ সঠিক তথ্য প্রেরণ করুন। যথাযোগ্য স্বীকৃতিসহ তথ্য সংশোধনে/সংযোজনে তা ব্যাবহার করা হবে। ইন্টারনেট টেকনোলজির কল্যাণে এই ওয়েবপেজটির সকল তথ্যই সহজে ও দ্রুত
পরিবর্তনযোগ্য। তথ্যগত কোন ত্রুটির কারণে অসন্তুষ্ট না হয়ে আমাদের
জানান, আমাদের দৃষ্টিতে আসা মাত্রই ত্রুটি সংশোধন করা হবে। -ওয়েবপেজ এডিটর। |